Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সিঙ্গুরে মমতাকে বিঁধল জোট

পকেট মেরে টিকিট কেটে দিলেন

মাস গেলে মজুরির পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে বাসে চেপেছিলেন এক দল শ্রমিক। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে আসতেই তাঁদের মধ্যে এক জনের মালুম হল, পুরো টাকাটাই পকেটমারি হয়ে গিয়েছে!

সিঙ্গুরের প্রচারসভায় অধীর চৌধুরী এবং সীতারাম ইয়েচুরি। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

সিঙ্গুরের প্রচারসভায় অধীর চৌধুরী এবং সীতারাম ইয়েচুরি। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ।

সন্দীপন চক্রবর্তী
সিঙ্গুর শেষ আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:০৮
Share: Save:

মাস গেলে মজুরির পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে বাসে চেপেছিলেন এক দল শ্রমিক। কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে আসতেই তাঁদের মধ্যে এক জনের মালুম হল, পুরো টাকাটাই পকেটমারি হয়ে গিয়েছে! কন্ডাক্টরকে জানালেন, ভাড়া দিতে তিনি অপারগ। কন্ডাক্টর আবার পাল্টা হুমকি দিলেন, ভাড়া না দিলে বাসই যাবে না। বাসের বাকিরা তখন অধৈর্য। তাঁদের তো পকেট-ভর্তি মজুরি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার তাড়া! এই গোলমালের মধ্যেই উঠে দাঁড়ালেন এক জন। বললেন, ওই শ্রমিকের ভাড়ার পাঁচ টাকা তিনি দিয়ে দিচ্ছেন। কন্ডাক্টর বরং সবাইকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

ধান কেটে নেওয়া এবড়ো খেবড়ে মাঠে মুঠো মুঠো মহিলা-পুরুষের সামনে রবিবার সন্ধ্যায় গল্পটা বলছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। গল্প শেষ করে জানতে চাইলেন, ‘‘বলুন তো কে এই ভদ্রলোক? যিনি বাসের টিকিটের পয়সা দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন?’’ মাঠ জুড়ে জনতা উসখুশ করছে। তার মধ্যেই এক মহিলা বলে ফেললেন, ‘‘ওই পকেটমারটা নয়তো?’’ প্রশ্ন লুফে নিলেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক। ‘‘ঠিক বলেছেন! পাঁচ হাজার টাকা পকেটমারি করার পরে পাঁচ টাকা বাসভাড়া মিটিয়ে মহান হতে চেয়েছিলেন। আপনাদের এখানে গত কাল এসে যিনি আবার বলে গিয়েছেন জমি ফেরত দেবই, তিনি একই কাজ করছেন!’’ হো হো হেসে সমর্থন জানাল জনতা।

ঘটনাস্থল সিঙ্গুর। বৈঁচিপোতা গ্রাম পঞ্চায়েতের খাঁপুকুর। এক চিলতে গ্রামে চাষের জমির উপরে সভা করে যেখান থেকে সিপিএম এবং কংগ্রেসের জোটের শীর্ষ নেতৃত্ব পাল্টা জানিয়ে দিলেন, ক্ষমতায় এলে সিঙ্গুরে শিল্প করাই তাঁদের লক্ষ্য। শিল্প ফিরিয়ে কর্মসংস্থানের পথেই গোটা রাজ্য এবং সিঙ্গুরেরও বেশি উপকার সম্ভব বলে তাঁদের বিশ্বাস। সিপিএমের ইয়েচুরি এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বাড়তি পাওনা, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেনও সিঙ্গুরে দাঁড়িয়ে সওয়াল করে গেলেন ওই জমিতে শিল্পের পক্ষেই।

হুগলি জেলায় ভোট ৩০ এপ্রিল। বাম-কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা সিঙ্গুরে পা দেওয়ার আগের দিনই তাই ছুটে এসেছিসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পাঁচ বছর আগের পুরনো সুরেই আবার ফিরে গিয়ে জানিয়েছিলেন, অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত দেওয়াই তাঁর অঙ্গীকার। সিঙ্গুরের অন্য প্রান্তে গিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর সেই অঙ্গীকারকেই বিঁধেছেন অধীরেরা। প্রদেশ সভাপতির মন্তব্য, ‘‘ভোট এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী এসে বলছেন, কমিটমেন্ট, কমিটমেন্ট, কমিটমেন্ট! উরিব্বাবা! এই তো বলছিলেন, জমি ফেরত আসতে ৫০ বছরও লাগতে পারে। এখন আবার বলছেন, আর এক বার ক্ষমতায় আনো। জমি ফেরত দিয়েই ছাড়ব!’’ এমন অঙ্গীকার যে নেহাতই লোক-ভোলানো, বোঝাতে চেয়েছেন অধীর। আর গল্প বলার আগে ইয়েচুরি বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আবার প্রতারণা করছেন! আবার বিভ্রান্তি তৈরি করছেন!’’ তবে কৌশলগত কারণেই হবে হয়তো, এক মঞ্চে এলেও মুখোমুখি হননি অধীর-ইয়েচুরি। প্রথম জন মঞ্চ ছাড়ার পরে দ্বিতীয় জন এসেছেন।
এবং পরে এসে খোঁজ নিয়েছেন, অধীর কিছু মনে করেননি তো!

অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই সিঙ্গুরে ফের কারখানা করাই যে তাদের লক্ষ্য, আগেই ঘোষণা করেছিল বামেরা। এই সিঙ্গুর থেকেই গত জানুয়ারি মাসে শিল্পের দাবিতে শালবনি পর্যন্ত জাঠার সূচনা করতে গিয়ে স্পষ্ট করে সেই লক্ষ্যের কথা জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মাঝে ভোট-মরসুমে মমতা কৃষকদের ভাবাবেগ স্পর্শ করার চেষ্টা করেছেন জমি ফেরতের কথা মনে করিয়ে দিয়ে। কিন্তু ইয়েচুরি, অধীরেরা এ দিন বুঝিয়ে দিলেন, জোট সরকার শুধুই আবেগ নিয়ে না খেলে শিল্পের পথে হাঁটতে চাইবে। অধীরের
কথায়, ‘‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি ৮৮ বছর পরে কমিউনিস্ট কিউবায় যেতে পারেন, তা হলে কংগ্রেস-সিপিএম এক হতেই পারে! সিঙ্গুরে আবার শিল্পও হতে পারে।’’

তবে হুগলির সিপিএম নেতাদের মঞ্চে পেয়ে অধীর এ দিন শুনিয়ে দিতে ভোলেননি, ‘‘টাটাকে শিল্পের জন্য ডেকে আনা ঠিক ছিল। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার তখন যা যা করেছিল, সব ঠিক হয়নি। বিরোধী নেত্রী যখন হাইওয়ের উপরে ধর্না দিয়ে বসে আছেন, তখন মুখ্যমন্ত্রীর দুর্বলতা মানুষ ভাল ভাবে নেয়নি।’’ সমালোচনা মেনে নিয়েই সিঙ্গুরের সিপিএম প্রার্থী রবীন দেব বলেছেন, ‘‘ভুল-ত্রুটি আমরা যা করেছিলাম, চিহ্নিত করেছি। মানুষকে বলেছি, সেই ভুল আর হবে না। কোনও ভাবেই হবে না!’’

ভুল হবে না বলে সিঙ্গুরের কাছে আশা রাখছেন অর্ধেন্দুবাবুও। প্রাক্তন এই আমলার ভাবনা, ‘‘এক পক্ষের শিল্প নিয়ে কোনও উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। বামেরা আবার নতুন উদ্যমে নেমে ডাকছে শিল্পকে। মানুষকে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে, কার সঙ্গে গেলে ভাল হবে। আরও এক বার মানুষ চিনতে আপনাদের ভুল হবে, আমার মনে হয় না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE