Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ডাক্তারের ভুলে মৃত্যু, ক্ষতিপূরণ এ বার ১৬ লক্ষ

হাসপাতালে অন্তিম শয্যায় রোগিণী একটি চিরকুটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘ডাক্তার আমাকে দেখেনি। এখানে ফেলে দিয়ে গেছে।’ চিকিৎসায় গাফিলতির জেরে ওই রোগিণীর মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসক ও হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে ১৬ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা ক্রেতা সুরক্ষা আদালত। বুধবার আদালতের রায়ে জানানো হয়েছে, এক মাসের মধ্যে মৃতার পরিবারের হাতে ওই টাকা দিতে হবে। দেরি করলে প্রতিদিন জরিমানা হিসেবে দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা।

শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়।

শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়।

অনুপ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৬
Share: Save:

হাসপাতালে অন্তিম শয্যায় রোগিণী একটি চিরকুটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘ডাক্তার আমাকে দেখেনি। এখানে ফেলে দিয়ে গেছে।’ চিকিৎসায় গাফিলতির জেরে ওই রোগিণীর মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসক ও হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে ১৬ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা ক্রেতা সুরক্ষা আদালত। বুধবার আদালতের রায়ে জানানো হয়েছে, এক মাসের মধ্যে মৃতার পরিবারের হাতে ওই টাকা দিতে হবে। দেরি করলে প্রতিদিন জরিমানা হিসেবে দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা।

চিকিৎসা-বিভ্রাটে অনুরাধা সাহা নামে এক মহিলার মৃত্যুর পরে তাঁর স্বামী, প্রবাসী চিকিৎসক কুণাল সাহা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দীর্ঘ আইনি লড়াই চালিয়ে সম্প্রতি বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। সেই ঘটনায় তিন চিকিৎসক এবং হাসপাতালকে ক্ষতিপূরণের টাকা মেটাতে হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের ১৬ লক্ষ টাকার মধ্যে এক চিকিৎসককে দিতে হবে ১০ লক্ষ এবং বাকিটা মেটাতে হবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে।

ঠিক কী ঘটেছিল?

রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা দফতর সূত্রের খবর, বছর চারেক আগে গলব্লাডার বা পিত্তথলি থেকে পাথর বার করার জন্য অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে মৃত্যু হয় নৈহাটির বাসিন্দা শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়ের। ঘটনাটি ঘটে ই এম বাইপাসের ধারে অ্যাপোলো গ্লেনেগল্স হাসপাতালে। অভিযোগ ওঠে, প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা না-করেই শর্মিষ্ঠাদেবীর অস্ত্রোপচার করেছেন ওই হাসপাতালের শল্যচিকিৎসক পূর্ণেন্দু রায়। মৃতার স্বামী শুভ্রশঙ্কর মুখোপাধ্যায় ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে জানান, পেটে অসহ্য ব্যথা হতে থাকায় ২০১০ সালের ২১ মার্চ তাঁর স্ত্রীকে অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ওই চিকিৎসকের নির্দেশেই। হাসপাতাল জানায়, ৩০ হাজার টাকা খরচ হবে। শুভ্রশঙ্করবাবুর অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের আগে ওই চিকিৎসক কোনও বিশেষ পরীক্ষানিরীক্ষা করার পরামর্শ দেননি। পুরনো একটি রিপোর্ট দেখে তিনি শুধু বলেছিলেন, পিত্তথলির পাথর বার করে দিলেই রোগিণী সুস্থ হয়ে উঠবেন।

আদালত রায় দিতে গিয়ে জানায়, ২৩ মার্চ শর্মিষ্ঠাদেবীর অস্ত্রোপচার হয়। ২৫ মার্চ হাসপাতাল তাঁকে ছেড়েও দেয়। বাড়ি ফেরার কয়েক দিনের মধ্যে ফের অসহ্য ব্যথা শুরু হয় তাঁর পেটে। বমি হতে থাকে। চিকিৎসকের নির্দেশে ৪ এপ্রিল আবার তাঁকে ভর্তি করানো হয় ওই হাসপাতালে। এ বার বলা হয়, এমআরসিপি, ইআরসিপি ইত্যাদি পরীক্ষা করাতে হবে। রোগিণীর পরিবার তাতে রাজি হয়। কিন্তু ওই সব পরীক্ষা করার পরে রোগিণী আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুভ্রশঙ্করবাবু ক্রেতা সুরক্ষা আদালতকে জানিয়েছেন, পরীক্ষায় ধরা পড়ে, অস্ত্রোপচারের পরেও পিত্তনালিতে এক টুকরো পাথর থেকে গিয়েছিল। ওই চিকিৎসক সেটা বুঝতে পারেননি। সেই পাথর অগ্ন্যাশয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। অস্ত্রোপচারের পরে সেই ক্ষত আরও ছড়িয়ে পড়ায় শর্মিষ্ঠাদেবীর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। এক সময় তাঁকে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়। ২০১০ সালের ৭ মে সেখানেই মারা যান শর্মিষ্ঠাদেবী।

আদালত সূত্রের খবর, ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটেই রোগিণীর শয্যার পাশে তাঁর হাতে লেখা একটি কাগজ পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান তাঁর স্বামী। শর্মিষ্ঠাদেবী সেই চিরকুটেই লিখেছেন, ‘ডাক্তার আমাকে দেখেনি। এখানে ফেলে দিয়ে গেছে।’ প্রমাণ হিসেবে চিরকুটটি আদালতে পেশ করেন তাঁর স্বামী। বিচারক রায় দিতে গিয়ে রোগিণীর এই অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন।

শুভ্রশঙ্করবাবু স্ত্রীর মৃতদেহ নিতে গিয়ে জানতে পারেন, বিল হয়েছে ১৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ৭৩৬ টাকা। পেশায় সরকারি কর্মী শুভ্রশঙ্করবাবু তখনও পর্যন্ত ৮০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে দেহ নেওয়ার জন্য রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের দ্বারস্থ হন তিনি। সরকারের নির্দেশে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ দেহ ছেড়ে দেন। মৃতার পরিবারের কাছে তাঁরা আর কোনও টাকা দাবি করেননি।

চিকিৎসকের গাফিলতিতেই স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ জানান শুভ্রশঙ্করবাবু। তারই ভিত্তিতে এসএসকেএম হাসপাতালের অধিকর্তা-সহ তিন চিকিৎসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য দফতর। সেই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, ওই মহিলার মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসক পূর্ণেন্দু রায় দায় এড়াতে পারেন না। ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের বিচারক বিপিন মুখোপাধ্যায় জানান, তথ্যপ্রমাণের উপরে ভিত্তি করেই ওই চিকিৎসককে ১০ লক্ষ এবং হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে ছ’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে।

অভিযুক্ত চিকিৎসক পূর্ণেন্দু রায় বৃহস্পতিবার বলেন, “রায়ের প্রতিলিপি পাইনি। পেলে উচ্চ আদালতে যাব।” আর অ্যাপোলো গ্লেনেগল্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে এক আধিকারিক শুক্রবার জানান, তাঁরা এখনও ক্রেতা সুরক্ষা রায়ের প্রতিলিপি হাতে পাননি। তাই এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।

“এই ধরনের ঘটনা ঘটলে ক্রেতা সুরক্ষা দফতর রোগীর পরিবারের পাশেই দাঁড়াবে,” বলেছেন রাজ্যের ক্রেতা সুরক্ষা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE