এই বাংলাতেই ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। এবং জিতেওছিলেন! তখন অবশ্য তিনি ‘মাফলার ম্যান’ নন।
মঙ্গলবার দিল্লি বিধানসভা ভোটের ফলে কেজরীবালের ঝাড়ুতে বিরোধীরা সাফ, বিধানসভায় কার্যত ‘সির্ফ আপ’। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে দ্বিতীয় বার শপথের জন্য তৈরি তিনিই প্রায় ত্রিশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন একটি ভোটে।
কী রকম?
তখন খড়্গপুর আইআইটি-র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র কেজরীবাল। থাকতেন নেহরু হলের ‘সি’ ব্লকে, ফার্স্ট ফ্লোর ইস্টে। প্রতি বছর হস্টেল ম্যানেজমেন্ট কমিটির নির্বাচন হতো। পুরোপুরি অরাজনৈতিক নির্বাচন। হস্টেল সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা করতে ও বিভিন্ন সুবিধে-অসুবিধেগুলির দিকে নজর রাখতে নিজেদের মধ্যে থেকেই কয়েক জন প্রতিনিধি নির্বাচন করতেন পড়ুয়ারা। কেউ হতেন কালচালার সেক্রেটারি, কেউ মেস সেক্রেটারি, আবার কারও কাঁধে পড়ত হস্টেলের রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা খেলাধুলোর দায়িত্ব। সেই ভোটেই প্রার্থী হয়েছিলেন অরবিন্দ, সহপাঠী ও অন্য পড়ুয়াদের কাছে যিনি পরিচিত ছিলেন ‘কেজরী’ নামে।
সেই সময়ে একই হস্টেলের আবাসিক ছিলেন, এমন কয়েক জনের কিঞ্চিৎ ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতি বলছে, সেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে মেস চালানো ও সাংস্কৃতিক বিষয় দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কেজরীবাল। তাঁর সতীর্থেদের মতে, কেজরীবালের আম আদমি পার্টি তৈরি ও দিল্লি ভোটে সাফল্য পাওয়ার সোপান আইআইটি-র হস্টেলে ওই ভোটে জেতার মধ্যেই হয়তো তৈরি হয়েছিল।
আইআইটি-তে কেজরীর চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র ছিলেন বর্তমান জুট কমিশনার, আইএএস সুব্রত গুপ্ত। ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র হলেও তিনি কেজরীর সঙ্গে একই হস্টেল— নেহরু হলে থাকতেন। তাঁর কথায়, “হস্টেল জীবনে যেটুকু ওঁকে চিনেছি, হস্টেলের নির্বাচনে জিতে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে যে বিশ্বস্ততা ওঁর মধ্যে দেখেছি, তাতে মনে হয় দিল্লির মানুষের চাহিদা নিশ্চয়ই পূরণ করতে পারবেন।”
১৯৮৫-তে খড়্গপুর আইআইটি-তে ভর্তি হন কেজরীবাল। তখন তিনি সদ্য আঠারো। হস্টেলের আবাসিক-সতীর্থ ও সহপাঠীরা জানাচ্ছেন, শুরু থেকেই কেজরী ছিলেন শান্তশিষ্ট, চুপচাপ ও নির্ঝঞ্ঝাট গোছের। ক্যান্টিনে গিয়েও অন্যদের মতো চেঁচামেচি করতেন না। বরং, বেশির ভাগ
সময়েই তিনি দরজা বন্ধ করে বইয়ে ডুব দিতেন। আর তাই বন্ধুরা হামেশাই খেপাতেন তাঁকে।
সতীর্থদের একাংশের স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ এ দিন যাঁর কাছে ধরাশায়ী হলেন, সেই কেজরীবালকে আইআইটি-তে কান ধরে ওঠবোস করতে হয়েছিল। সিনিয়র ব্যাচের নির্দেশে। সেই সময়ে খড়্গপুর আইআইটি কুখ্যাত ছিল র্যাগিংয়ের জন্য, যা সব চেয়ে বেশি হতো নেহরু হল, পটেল হলের মতো হস্টেলে। র্যাগিংয়ের থেকে নিষ্কৃতি পেতে দু’ব্যাচ সিনিয়র ছাত্রদের শরণাপন্নও হয়েছিল অরবিন্দদের গোটা ব্যাচই। শেষমেশ ওই কান ধরে ওঠবোসের মতো ‘হাল্কা দাওয়াই’ নিয়েই রেহাই পান কেজরী ও তাঁর সহপাঠীরা।
এখন যেমন কেজরীবালের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে তাঁর মাফলার, আইআইটি-তে পড়াকালীন তিনি মাফলার ব্যবহার করতেন বলে সতীর্থদের অনেকেই মনে করতে পারছেন না। তবে তাঁদের বিলক্ষণ মনে আছে, কেজরীবাল ছিলেন নিরামিষাশী। সেই সময়ে হস্টেলে সপ্তাহে দু’-এক দিন পড়ুয়াদের জন্য মুরগির মাংস বরাদ্দ ছিল। নিরামিষাশী কেজরীবালের অবশ্য সেই ‘স্পেশ্যাল খাবার’ নিয়ে কোনও উৎসাহ ছিল না!
তবে কেজরীর প্রবল উৎসাহ ছিল থিয়েটারে। খড়্গপুর আইআইটি-তে অরবিন্দ কেজরীবাল ও অন্য কয়েক জনের উদ্যোগে কয়েকটি হিন্দি নাটকও মঞ্চস্থ হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন পুরনো সহপাঠীরা। আবার দেওয়ালির সময়ে বিভিন্ন হস্টেলের মধ্যে আলপনা আঁকার মতো বিষয়ের প্রতিযোগিতা হতো। ১৯৮৭ সালে নেহরু হলের বিজয় মিছিলের অগ্রভাগেই থাকতে দেখা গিয়েছিল কেজরীবালকে।
এ দিন দিল্লিতে আপ-এর বিপুল জয়ের পর খড়্গপুর আইআইটি-র বহু পড়ুয়ার মধ্যেই স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস। কেউ ঝাড়ু হাতে হস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়েন, কেউ আবার ‘আম আদমি জিন্দাবাদ’ বলে গলা ফাটাচ্ছেন। কেজরীবাল যে অন্য রকম কিছু করবেন, তার আঁচ অবশ্য আইআইটি পেয়েছিল কয়েক বছর আগেই।
২০০৯ সাল। সরকারি চাকরি ছেড়ে সমাজকর্মী অরবিন্দ তথ্য জানার অধিকার আইনের জন্য তখন লড়াই চালাচ্ছেন। সেই বছরই ‘ডিস্টিংগুইশড অ্যালামনি অ্যাওয়ার্ড’ হিসেবে অরবিন্দকে বেছে নিয়েছিলেন খড়্গপুর আইআইটি কর্তৃপক্ষ। তারও আগে ২০০৫ সালে কানপুর আইআইটিও সামাজিক আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে ‘সত্যেন্দ্র দুবে স্মৃতি পুরস্কার’ দিয়েছিল খড়্গপুর আইআইটির এই প্রাক্তনীকে।
১৯৮৯-এ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক হন অরবিন্দ। সেই সময়কার শিক্ষকদের সকলেই প্রায় অবসর নিয়েছেন বা অন্যত্র চলে গিয়েছেন। তবে ১৯৭৬ সাল থেকে খড়্গপুর আইআইটিতে এখনও রয়েছেন মেকানিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক শঙ্করকুমার সোম। শঙ্করবাবু জানান, ২০১২ সালে আইআইটির প্রাক্তনীদের পুনর্মিলন অনুষ্ঠান ‘প্যান আইআইটি’-তে দেখা হয়েছিল অরবিন্দের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর হিসেবে হাজির ছিলেন শঙ্করবাবুও। তাঁর কথায়, “অরবিন্দ নিজে এসে আমার সঙ্গে দেখা করল। মনটা ভরে গিয়েছিল।”
উজ্জীবিত আইআইটি-র পড়ুয়ারাও। মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, দিল্লির অটল আশুতোষ অগ্রবালের কথায়, “জানতাম, আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তনীর হাত ধরে ফের সাফল্য পাবে আপ। দিল্লিতে গিয়ে কেজরীবালের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা চলছে।” মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষক-পড়ুয়া সীতাংশু চক্রবর্তী বলছিলেন, “কেজরীবালের হাত ধরে জনমুখী উন্নয়ন হবে বলেই বিশ্বাস করি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy