এত দিন ধরে ভারত যা বলে আসছিল, হুবহু সে কথাই উঠে এল ডেভিড কোলম্যান হেডলির জবানবন্দিতে। ২৬/১১ মামলার এই রাজসাক্ষী দ্ব্যর্থহীন ভাবে দাবি করল, পাক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইবা এবং পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই হাত মিলিয়েই মুম্বইয়ে আক্রমণ চালিয়েছে। লস্কর নেতা জাকিউর রহমান লকভি, জামাত উদ-দুয়া নেতা হাফিজ সইদের পাশাপাশি আইএসআই-এর মেজর আলি এবং মেজর ইকবাল নামে দু’জন কর্তার নাম করেছে সে। প্রথম দু’বার ব্যর্থ চেষ্টার পরে তৃতীয় বার সফল হয় মুম্বই হামলা, সেটাই ২৬/১১।
হেডলির জবানবন্দিকে হাতিয়ার করে নতুন করে ইসলামাবাদকে চেপে ধরতে চাইছে ভারত।
মার্কিন মুলুক থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সোমবার মুম্বইয়ের আদালতে সাক্ষ্য দিল হেডলি। ইতিমধ্যেই মার্কিন আদালতে ৩৫ বছরের কারাদণ্ড পেয়েছে সে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তার সমঝোতা হয়েছে যে, তাকে প্রত্যর্পণ করা হবে না। কিন্তু ভারতীয় আদালতে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হলে তবেই তার প্রাণ বাঁচবে। সেই মোতাবেক হেডলিকে মুম্বই মামলার রাজসাক্ষী করতে উদ্যোগী হন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। ডিসেম্বর মাসে রাজসাক্ষী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় হেডলি। মুম্বইয়ের আদালত ইতিমধ্যেই তাকে ক্ষমা করেছে। সরকারি কৌঁসুলি উজ্জ্বল নিকম এ দিন জানিয়েছেন, মঙ্গলবারও হেডলির কাছ থেকে লস্করের ভূমিকা নিয়ে আরও তথ্য জানার চেষ্টা করবেন তিনি।
হেডলির সাক্ষ্য নিয়ে আজ খুব বেশি কিছু বলেনি কেন্দ্র। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে খবর, সন্ত্রাস নিয়ে নয়া নথি তৈরি করে ইসলামাবাদকে দেওয়া হবে। ভারতের মাটিতে সন্ত্রাসে পাক রাষ্ট্রীয় শক্তির ভূমিকা নেই, সবটাই রাষ্ট্র-বহির্ভূত শক্তির কাজ বলে দাবি করে ইসলামাবাদ। হেডলির কথা সেই দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে বলে এ দিন মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। এর আগেও বারবারই দিল্লির তরফে আইএসআই এবং হাফিজ সইদ-লকভির ভূমিকা নিয়ে তথ্যপঞ্জী পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাক সরকার সন্তোষজনক ব্যবস্থা নেয়নি বলে দিল্লির অভিযোগ। সম্প্রতি পঠানকোটের সেনাঘাঁটিতে হামলার ঘটনা নিয়েও দু’পক্ষের তরজা চলছে। রবিবারই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশবাসীকে সতর্ক করে বলেছেন, ২৬/১১-র মতো ঘটনা আবার ঘটার সম্ভাবনা পূর্ণ মাত্রায় রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আজ হেডলি যে ভাবে নাম করে করে আইএসআই অফিসার এবং লস্কর জেহাদিদের কথা বলেছে এবং তাদের কর্মকাণ্ডের বিশদ বিবরণ দিয়েছে, সেটা ভারতের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিল। এবং হেডলি যেহেতু মার্কিন হেফাজতেই রয়েছে, ফলে হাফিজ সইদদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হওয়ার জন্য আমেরিকার উপরেও চাপ বাড়াতে পারে ভারত।
ডেনমার্কের একটি সংবাদপত্রে হানার ছক কষার অভিযোগে পাক কূটনীতিক সৈয়দ সেলিম গিলানি ও মার্কিন নাগরিক অ্যালিস শেরিল হেডলির ছেলে ডেভিডকে প্রথমে গ্রেফতার করেছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-ই। তার পরেই জানা যায়, মুম্বই হামলার ছক কষার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে হেডলিকে ভারতে পাঠিয়েছিল লস্কর। ভারতে ঢোকার জন্যই সে দাউদ গিলানি নাম পরিবর্তন করে ডেভিড হেডলি হয়ে যায়।
এক সময়ে আন্তর্জাতিক মাদক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত ছিল হেডলি। সেই সময়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার চর হিসেবেও কাজ করেছিল সে। হেডলির দাবি, মাদক পাচার করতে গিয়েই পাক-আফগান সীমান্তে লান্ডিকোটালে ধরা পড়েছিল সে। হেডলির কথায়, ‘‘আইএসআইয়ের মেজর আলি জেরা করতে আসে। সাদা চামড়ার পাক পাসপোর্টধারী আমি যে ওদের কাজে লাগতে পারি তা তখনই বুঝতে পারে আইএসআই।’’ তখন থেকেই পাক গুপ্তচর সংস্থার সঙ্গে তার যোগ শুরু। লস্কর-ই-তইবার সঙ্গে তার যোগ আইএসআই-এর সূত্রেই।
আজ সাক্ষ্যে হেডলি জানিয়েছে, হাফিজ সইদের বক্তৃতা শুনে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয় সে। পরে পাকিস্তান ও পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন শিবিরে প্রশিক্ষণ নেয়। সেখানে হাফিজ এবং লকভি প্রায়ই হাজির থাকত। হেডলির কথায়, ‘‘আমি কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে লড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু লকভি আমায় বলে, ওই ধরনের কাজের পক্ষে আমার বয়স বড্ড বেশি। আমাকে আরও রোমাঞ্চকর কাজ দেওয়া হবে।’’ ভারতে এসে মুম্বই হামলার জন্য তথ্য সংগ্রহ করাটাই ছিল সেই ‘কাজ’। এর পরে সাত বার মুম্বই এসে হামলার জন্য তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে যায় সে। তুলে নিয়ে যায় প্রয়োজনীয় ভিডিও, ছবি। হেডলির দাবি, সেই সময়ে লস্করের তরফে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত মুম্বই হামলার আর এক অভিযুক্ত সাজিদ মির।
হেডলি জানিয়েছে, আজমল কসাব ও তার সঙ্গীরা ২০০৮-এর সেপ্টেম্বর মাসেই হামলা চালাতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বার করাচির কাছে ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা লেগে তাদের নৌকো ডুবে যায়। অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। অক্টোবরে দ্বিতীয় চেষ্টাও ব্যর্থ। বারবার তিন বার। নভেম্বরে মুম্বই উপকূলে নোঙর করে তাদের নৌকো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy