Advertisement
১১ মে ২০২৪

মিশরে ভাঙল রুশ বিমান, মৃত ২২৪

ছড়িয়ে থাকা দেহগুলির কোনও কোনওটির পকেটে তখনও বেজে চলেছে মোবাইল ফোন। নিরাপত্তা রক্ষীরা ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে ব্যাগে পুরছেন সেগুলি। প্রথমে এদিক-ওদিক থেকে সামান্য গোঙানির শব্দ কানে আসছিল রক্ষীদের। তবে কি দেহের স্তূপের মধ্যে কোনটিতে প্রাণ আছে?

সংবাদ সংস্থা
কায়রো শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৩৫
Share: Save:

ছড়িয়ে থাকা দেহগুলির কোনও কোনওটির পকেটে তখনও বেজে চলেছে মোবাইল ফোন। নিরাপত্তা রক্ষীরা ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে ব্যাগে পুরছেন সেগুলি। প্রথমে এদিক-ওদিক থেকে সামান্য গোঙানির শব্দ কানে আসছিল রক্ষীদের। তবে কি দেহের স্তূপের মধ্যে কোনটিতে প্রাণ আছে?

সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সে আশা ফুরোয়। মিশরের নিরাপত্তা রক্ষীরা জানিয়ে দেন, বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে সব আরোহীরই। যাঁদের মধ্যে ছিল ১৭টি শিশুও।

২১৭ জন যাত্রী এবং সাত জন বিমান কর্মী-সহ শনিবার মিশরের সিনাইয়ে ভেঙে পড়ল রুশ বিমান। মিশরের সৈকত শহর শর্ম এল-শেখ থেকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে যাচ্ছিল বিমানটি। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণেই এই দুর্ঘটনা। কিন্তু শনিবার রাতে মিশরের আইএস জঙ্গিদের একটি শাখা সংগঠন জানায়, তারাই গুলি করে নামিয়েছে বিমানটি। যদিও এই দাবির সত্যতা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

মিশরের বিমান মন্ত্রক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, শর্ম এল-শেখ বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় সকাল ছ’টা নাগাদ আকাশে ওড়ে রুশ বিমানসংস্থা কোগালিমাভিয়ার মোট্রোজেট বিমানটি। এর পর ২৩ মিনিটের মাথায় রেডার থেকে উধাও হয়ে যায় এয়ারবাস এ৩২১। রেডার থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আগে মাটি থেকে ৩১ হাজার ফুট উঁচুতে ছিল বিমানটি। ঘটনার মুহূর্তে খুব দ্রুত মাটির দিকে নেমে আসছিল বিমানটি। সেই সময় বিমানের গতি ছিল মিনিটে ১৮০০ মিটার। রওনা হওয়ার পর ২৫ মিনিট না পেরোতেই আল-আরিশ শহরের ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে হাসানা এলাকার দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ভেঙে পড়ে এটি। প্রাণ হারান বিমানের প্রত্যেক আরোহী। মৃত যাত্রীদের প্রায় সকলেই পর্যটক। যাত্রী এবং বিমান কর্মীরা সবাই রুশ নাগরিক।

কী ভাবে ভেঙে পড়ল বিমানটি? উড়ানের উপর নজর রাখে সুইডেনের এমন একটি সংস্থা জানিয়েছে, স্বাভাবিক যাত্রা শুরু করেছিল এটি। তা হলে ২৩ মিনিটের মধ্যে কী ভাবে বিপদে পড়ল এয়ারবাস এ৩২১? বিমান মন্ত্রক জানিয়েছে, সঠিক কারণ এখনও অজানা। প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, যান্ত্রিক ত্রুটিতেই দুর্ঘটনা। রুশ সংবাদমাধ্যমগুলিও জানিয়েছে, রেডার থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিমানে সমস্যার কথা জানিয়েছিলেন চালক এবং কাছাকাছি কোনও বিমানবন্দরে নামার জন্য আবেদনও জানান তিনি। এর পরেই সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়।

তবে যান্ত্রিক ত্রুটির তথ্য উড়িয়ে পরে সামনে এসেছে দুর্ঘটনার আর একটি কারণও। জঙ্গি-হামলা। মিশরে আইএস-এর একটি শাখা টুইটারে দাবি করেছে, তারাই গুলি করে বিমানটি ধ্বংস করে দেয়। ‘‘সিনাই প্রদেশে একটি রুশ বিমানে হামলা চালিয়েছে আইএস জঙ্গিরা। বিমান ২২০ জনের বেশি যাত্রী ছিল। সকলেই নিহত।’’ তাদের একটি ওয়েবসাইটেও একই দাবি করেছে জঙ্গি সংগঠনটি। তবে এই দাবি নিয়ে মুখ খোলেনি পুলিশ বা মিশরের প্রতিরক্ষা দফতর। মিশরের প্রধানমন্ত্রী শেরিফ ইসমাইল বলেছেন, ‘‘ব্ল্যাকবক্সের তথ্য হাতে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।’’ তবে জঙ্গি-হানার সম্ভাবনা উড়িয়েছেন তিনিও।

মিশরের নিরাপত্তা আধিকারিকরা জানিয়েছেন, বিমানটির ধ্বংসস্তূপ মেলে হাসানার দুর্গম অঞ্চলে। তার উপর সিনাইয়ের ওই এলাকা জঙ্গি অধ্যুষিত হওয়ায় সেখানে পৌঁছতে সমস্যায় পড়ে সামরিক বিমান। সুইডেনের বিমান নজরদার সংস্থাটি জানিয়েছে, ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যায় এয়ারবাস এ৩২১। লেজের দিকের অংশটি পুড়ে যায় এবং সামনের দিকের বড় অংশ পাথরে ধাক্কা খেয়ে গুড়িয়ে যায়। ধ্বংসস্তূপ থেকে বিমানের ব্ল্যাকবক্সটি উদ্ধার হয়েছে। ব্ল্যাকবক্স থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের পরেই দুর্ঘটনা কারণ জানা যাবে। রুশ সংবাদসংস্থা জানিয়েছে, ‘বিমান চালানোর নিয়ম লঙ্ঘন করায় বিমানসংস্থাটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিমানসংস্থাটির মুখপাত্র ওকসানা গোলোভিন জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানুষের ভুলে এই দুর্ঘটনা, এমনটা মনে করছেন না তাঁরা। চালকের ১২ হাজার ঘণ্টা বিমান চালানোর অভি়জ্ঞতা ছিল। আকাশে পাড়ি দেওয়ার আগে শর্ম এল-শেখ বিমানবন্দরে প্রযুক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় বিমানটির। তখন কোনও ত্রুটি পাওয়া যায়নি।

দুর্ঘটনার খবর পেয়েই সেন্ট পিটার্সবার্গের পুলকোভো বিমানবন্দরে ভিড় জমাতে শুরু করেন মৃতদের পরিবারের লোকেরা। সেই ভিড়েই ছিলেন এলা স্মারনোভা। ২৫ বছরের তরুণী বলেন, ‘‘বাবা-মা’র সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল। বিমানে ওঠার পরেও ওদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। এখন খবরটা শুনলাম। আমি হয়তো আর কোনও দিনই ওদের দেখতে পাব না।’’ উদ্ধারকর্মীরাও জানাচ্ছেন, দেহগুলিতে সিট বেল্ট বাঁধা ছিল তখনও। কারও কারও মোবাইল বেজে উঠছিল মাঝে মাঝে।

রবিবার দেশে জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মৃতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি। শোক প্রকাশ করেছেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল-সিসি। সিনাইয়ের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রীরা। উদ্ধার কাজ দ্রুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন পুতিন। মিশরের প্রসিকিউটার জেনারেল নাবিল সাদেক জানিয়েছেন, ময়নাতদন্তের পর দেহগুলি রুশ দূতাবাসে পাঠানো হবে। সেখান থেকে পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে সেগুলি। রুশ সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে, সম্প্রতি বিমানের ইঞ্জিনে গোলমালের কথা সংস্থাকে জানিয়েছিলেন কর্মীরা। একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, গত সপ্তাহেও বিমান ওড়ার আগে ইঞ্জিন চালু না হওয়ায় একাধিক বার সমস্যায় পড়েন চালক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE