কার্যত ওঁরাই যে গ্রামবাংলায় চিকিৎসা-পরিকাঠামোর অন্যতম স্তম্ভ, অনেক দিন হল রাজ্য সরকার তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু এত দিন ওঁদের পেশায় সরকারি সিলমোহর পড়েনি। এ বার তার পথ খুলছে। সরকারি স্বীকৃতি পেতে চলেছেন ডিগ্রিহীন ‘হাতুড়ে’ ডাক্তারেরা।
স্বাস্থ্য দফতর স্থির করেছে, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় দু’লক্ষ হাতুড়েকে সরকারি তরফে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আর সেই তালিমের কাগজ দেখিয়ে ওঁরা ‘বৈধ’ ভাবে চিকিৎসা করতে পারবেন। যে সিদ্ধান্ত ঘিরে আশাবাদের পাশাপাশি সংশয়ও দানা বেঁধেছে।
বিধি মোতাবেক, তথাকথিত হাতুড়েরা মানুষের চিকিৎসা করতে পারেন না। অথচ হাজারো চেষ্টাতেও গ্রামে ডিগ্রিধারী সরকারি ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে জেলায়-জেলায় হাতুড়েদের অস্তিত্ব সরকারকে মেনে নিতে হয়েছে।
বলতে গেলে দু’পক্ষে এক ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের ৩৮ হাজার গ্রামে হাতুড়ে প্রায় দু’লক্ষ। আর রাজ্যে নথিভুক্ত ডিগ্রিধারী ডাক্তার সাকুল্যে ৪০ হাজার!
অর্থাৎ গ্রামে-গঞ্জে হাতুড়ের প্রয়োজনীয়তা তুঙ্গে। এই পরিস্থিতিতেই হাতুড়ে চিকিৎসাকে ‘বৈধতা’র তকমাদানের পরিকল্পনা, যার ভিত্তি হবে প্রশিক্ষণ। স্বাস্থ্যভবনের খবর, বিষয়টিতে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবুজ সঙ্কেত মিলেছে। দিন কয়েকের মধ্যে পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা চূড়ান্ত হয়ে যাবে। রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, ‘‘বড় নীতিগত সিদ্ধান্ত। রাজ্য জুড়ে প্রশিক্ষণ চলবে। হাতুড়ের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। অনেক দিক মাথায় রেখে এগোতে হবে।’’
স্বাস্থ্যকর্তাদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গই দেশের প্রথম রাজ্য, যেখানে হাতুড়েরা সরকারি তরফে এমন তালিম পাবেন। কিন্তু হাতুড়ের সংজ্ঞাটা ঠিক কী?
কোনও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদিক ডিগ্রি না-নিয়েও যাঁরা গ্রামে-গঞ্জে মানুষের চিকিৎসা করেন, সরকারি নথিতে তাঁরাই ‘হাতুড়ে’ ডাক্তার। ওঁদের প্রথাগত কোনও তালিম যেমন নেই, তেমন চিকিৎসক হিসেবে মেডিক্যাল কাউন্সিল কিংবা হোমিওপ্যাথি কাউন্সিলে নামও নথিভুক্ত করা নেই। এই মুহূর্তে রাজ্যে ওঁদের সংখ্যা প্রায় দু’লক্ষ। অনেকে হামেশা ছোটখাটো অস্ত্রোপচারও
করে থাকেন।
গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার জোর বাড়াতে এ হেন লোকজনকে যাতে সরাসরি কাজে লাগানো যায়, সেই লক্ষ্যে বেসরকারি স্তরে কিছু প্রয়াস আগেই শুরু হয়েছিল। যেমন স্বাস্থ্য দফতরের টাকায় বীরভূমের গ্রামে হাতুড়েদের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা লিভার ফাউন্ডেশন। তার ফলাফল যাচাই করছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। লিভার ফাউন্ডেশনের প্রকল্পটির উপরে ভিত্তি করেই রাজ্য জুড়ে হাতুড়ে-তালিমের সরকারি তোড়জোড়।
হাতুড়েদের তরফে উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়েছে। ‘‘আমরা বহু দিন ধরে মুখ্যমন্ত্রীকে এই আবেদন করে আসছি। এতে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ছবিটা পুরোপুরি বদলে যাবে। সরকারি হাসপাতালে চাপ কমবে।’’— বলেন হাতুড়েদের সংগঠন ‘পল্লি চিকিৎসক সংযুক্ত সংগ্রাম কমিটি’র সাধারণ সম্পাদক কুশল দেবনাথ। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘প্রত্যম্ত গ্রামে ৭০% পরিষেবা হাতুড়েরাই দেন। তা ছাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, যেখানে কিনা ডাক্তারের ভীষণ অভাব, সেখানেও এঁদের ভাল ভাবে কাজে লাগানো সম্ভব।’’
তবে সংশয়ও রয়েছে। কী রকম?
এমনিতে হাতুড়ে সম্পর্কে অভিযোগের অন্ত নেই। যেমন তাঁরা নামের আগে অবৈধ ভাবে ‘ডাক্তার’ লেখেন, যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক দেন, রোগ কঠিন বুঝেও রোগীকে হাসপাতালে না-পাঠিয়ে বিপদ বাড়ান ইত্যাদি। বস্তুত হাতুড়ের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুও ঘটে আকছার। এমতাবস্থায় সরকারি প্রশিক্ষণের শংসাপত্রকে সামনে রেখে ওঁরা আরও ‘দুঃসাহসী’ হয়ে উঠবেন কি না, সেই সন্দেহ প্রকট হয়েছে চিকিৎসক মহলের একাংশে। হাওড়ায় হাতুড়েদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত এক প্রকল্পের অন্যতম কর্ণধার, সার্জন কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় মনে করেন, সরকারি তরফে নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলে খুবই ভাল। কিন্তু স্বীকৃতি দেওয়া হলে হিতে বিপরীত হওয়ার ভয় বেশি। ‘‘গ্যারান্টি কী যে, সরকারি ছাপ্পা পেয়ে ওঁরা আরও বেশি বেশি এক্তিয়ার লঙ্ঘন করবেন না?’’— প্রশ্ন কৃষ্ণেন্দুবাবুর। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের এক সিনিয়র চিকিৎসকের আক্ষেপ, ‘‘গ্রামে ডাক্তার পাঠানোর ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার হাতুড়েদের আপ্যায়ন করে ডাকছে! এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের কী হতে পারে?’’
স্বাস্থ্যকর্তাদের কী বক্তব্য?
স্বাস্থ্যভবন এ সব আশঙ্কাকে আমল দিচ্ছে না। বরং তাদের যুক্তি: সরকারি সিলমোহর থাকলে হাতুড়েদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। লুকোচুরি কমলে, যথাযথ তালিম থাকলে অভিযোগ কমবে। নিয়ম ভাঙলে শাস্তিও দেওয়া যাবে তাড়াতাড়ি। ‘‘গোড়াতেই কয়েকটা জিনিস স্পষ্ট করে দেওয়া হবে। হাতুড়েরা নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবেন না। কোনও ডিগ্রি পাবেন না। জটিল রোগের চিকিত্সা বা অপারেশন করতে পারবেন না। সরকারি চাকরিও পাবেন না।’’— বলেন এক স্বাস্থ্যকর্তা। তাঁর দাবি, ‘‘ওঁরা শুধু পারবেন যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রাথমিক চিকিত্সা করতে।’’
কিন্তু কত দূর পর্যন্ত চিকিৎসাকে ‘প্রাথমিক’ হিসেবে ধরা হবে, সেটাও তো হাতুড়েরাই স্থির করবেন! এ ক্ষেত্রে বিপদের সম্ভাবনা থাকছে না কি?
চিকিৎসকমহলে এই ধন্দও ঘুরপাক খাচ্ছে। সরকারি তরফে যার উত্তর মেলেনি। তবে এক স্বাস্থ্যকর্তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া, ‘‘গ্রামেও যাব না, অথচ মন্তব্য, সমালোচনা করে যাব, এটা হতে পারে না। চিকিৎসক সংগঠনগুলো গ্রামে ডাক্তারদের যাওয়া নিশ্চিত করতে পারেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy