Advertisement
১৯ মে ২০২৪

ঘুরপথে নেশার জোগান, নিষিদ্ধ গুটখা তৈরি করেই খাচ্ছে শহর

২০১৩ সালের ১ মে রাজ্য সরকার রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে বন্ধ করে দিয়েছিল গুটখা বিক্রি। তার পরে কেটে গিয়েছে এক বছর। কলকাতায় গুটখা বিক্রি বন্ধ হলেও গুটখা সেবন আদৌ বন্ধ হয়েছে কি? শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখলেন সুপ্রিয় তরফদার।দৃশ্য ১: বেহালা ট্রাম ডিপো এলাকা। রাস্তার ধারে খুপরির মতো ছোট ছোট দোকান। বছর বারোর খুদে থেকে বাহাত্তরের বৃদ্ধ ক্রেতা সবাই। অধিকাংশের হাতেই দু’টি করে ছোট প্যাকেট। একটি সুপুরি দেওয়া পানমশলার। অন্যটি জর্দার (তামাক)। দোকান থেকে কেনার পরেই পানমশলার প্যাকেটে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে জর্দা। তার পরে গোটা মিশ্রণটাই চালান হয়ে যাচ্ছে মুখের ভিতরে। এবং সেই সঙ্গেই শুরু হচ্ছে রাস্তার যত্রতত্র থুতু ফেলার ধুম। দৃশ্য ২: উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের একটি দোকান। সামনেই লম্বা করে ঝোলানো রকমারি রঙের পানমশলার প্যাকেট। ক্রেতা থেকে বিক্রেতা, সকলেই ইশারায় কথা বলছেন।

শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০৩:০৪
Share: Save:

দৃশ্য ১: বেহালা ট্রাম ডিপো এলাকা। রাস্তার ধারে খুপরির মতো ছোট ছোট দোকান। বছর বারোর খুদে থেকে বাহাত্তরের বৃদ্ধ ক্রেতা সবাই। অধিকাংশের হাতেই দু’টি করে ছোট প্যাকেট। একটি সুপুরি দেওয়া পানমশলার। অন্যটি জর্দার (তামাক)। দোকান থেকে কেনার পরেই পানমশলার প্যাকেটে মিশিয়ে ফেলা হচ্ছে জর্দা। তার পরে গোটা মিশ্রণটাই চালান হয়ে যাচ্ছে মুখের ভিতরে। এবং সেই সঙ্গেই শুরু হচ্ছে রাস্তার যত্রতত্র থুতু ফেলার ধুম।

দৃশ্য ২: উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের একটি দোকান। সামনেই লম্বা করে ঝোলানো রকমারি রঙের পানমশলার প্যাকেট। ক্রেতা থেকে বিক্রেতা, সকলেই ইশারায় কথা বলছেন। কারণ, বিক্রেতা গুটখা চিবোচ্ছেন। তাঁর পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়। আর ক্রেতারাও গুটখা চিবোতে চিবোতে কিনে রাখছেন আরও দু’তিনটি প্যাকেট। মুখেরটা শেষ হলেই সেগুলোর সদ্ব্যবহার হবে।

দৃশ্য ৩: একটি বেসরকারি বাসে কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে ব্যস্ত। কিন্তু মুখে কোনও কথা নেই। কারণ সেই গুটখা। এক বৃদ্ধ ভাড়া জানতে চাইলেন। এ বারও কন্ডাক্টরের মুখে জবাব নেই। দু’হাতের আঙুল তুলে বুঝিয়ে দিলেন ভাড়া কত।

দৃশ্য ৪: রবীন্দ্র সদন থেকে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে যাচ্ছে একটি বাস। পাশেই চলেছে এক মোটরবাইক। হঠাৎ ডান পাশের জানলা দিয়ে মুখ বার করে গুটখার থুতু ফেললেন এক যাত্রী। তা সোজা গিয়ে পড়ল মোটরবাইক-আরোহীর গায়ে। বাইক থামিয়ে, হেলমেট খুলে তিনি দু’চারটে বাছা বাছা বিশেষণ ছুড়লেন ঠিকই, তবে গতি বাড়িয়ে বাস ততক্ষণে নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে।

শুধু বেহালা, শ্যামবাজার বা চলন্ত বাস নয়। মহানগরের সর্বত্র একই চিত্র। আইনের ফাঁক গলে রাস্তার ধারে গজিয়ে উঠেছে একের পর এক গুটখার দোকান। তবে গুটখার প্যাকেট সেখানে মিলবে না। মিলবে গুটখা তৈরি করে নেওয়ার দরকারি রসদ।

কী বলছে স্বাস্থ্য দফতর?

রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র, চিকিৎসক সুমন বিশ্বাস বলেন, “রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা পালনের জন্য ফুড সেফ্টি অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া রয়েছে। কী ভাবে কাজ চলছে, সে বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে খোঁজখবর নেওয়া হবে।” পাশাপাশি দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, সরকার নির্দেশিকা দিলেও আইনের ফাঁক গলে মানুষ গুটখা খেয়েই যাচ্ছেন।

কী সেই আইনের ফাঁক?

আগে পানমশলা ও জর্দা একসঙ্গে মেশানো অবস্থায় গুটখা হিসেবে বিক্রি হত। প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকত গুটখা। এক বছর আগে সরকার যে বিজ্ঞপ্তি দেয়, তাতে উল্লেখ ছিল, ‘তামাক মিশ্রিত পানমশলা’র বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এখন বাজারে বিভিন্ন গুটখা সংস্থার তৈরি পানমশলার প্যাকেট মেলে। জর্দাও বিক্রি হয় আলাদা প্যাকেটে। তাতে অবশ্য তামাক লেখা থাকে। তামাক ও পানমশলা কোনওটিই আলাদা ভাবে এ রাজ্যে বিক্রি করা নিষিদ্ধ নয়। ফলে পানমশলা ও জর্দা আলাদা কিনে খেলে সেখানে সরকারের কিছু করার নেই। এ ক্ষেত্রে সরাসরি সরকারি আইনকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে, এমনটাও নয়। অর্থাৎ, ঘুরপথে এখনও দিব্যি চলছে গুটখা বিক্রি ও তার সেবন।

কী ভাবে ক্ষতি করে গুটখা?

ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমাদের মুখের ভিতরে এক ধরনের আবরণ থাকে। তামাক ও সুপুরির সঙ্গে তার সংযোগ হওয়া মাত্রই তাতে সাদা-কালো দাগ হতে থাকে। এই দাগ হওয়াকে প্রি-ক্যানসার (ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায়) বলে। আর এ ভাবেই ধীরে ধীরে তা ক্যানসারে রূপ নেয়। তিনি বলেন, “আইন রয়েছে, সেটা ভাল কথা। কিন্তু তার ফাঁক গলে সেই গুটখাই খাচ্ছেন মানুষ। নিজেদের সচেতনতা ছাড়া গুটখামুক্ত সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব।” এ ছাড়াও গুটখার প্রভাবে মুখগহ্বর ছোট হয়ে যায়। কারণ মুখের ভিতরে চামড়ার আবরণের সঙ্কোচন-প্রসারণের স্বাভাবিকত্ব নষ্ট হয়ে যায় গুটখা চিবোতে গিয়ে। পাশাপাশি, ফুসফুস, পাকস্থলী, খাদ্যনালীর ক্যানসার হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে বলে জানাচ্ছেন তিনি।

ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেন, “শুধু আইন করলে হবে না। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।” তাঁর মতে, প্রতি বছর ভারতে ক্যানসারে আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ শতাংশই ভুগছেন তামাকজাত দ্রব্যের নেশার কারণে।” সুবীরবাবুর প্রশ্ন, “দেশের ২৬টি রাজ্যে গুটখা বন্ধ হলে এ রাজ্যেই বা হবে না কেন?” এক বছর আগেই মহারাষ্ট্রে চর্ব্য তামাকজাত জিনিস বিক্রি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

গত বছর টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতালের তরফে একটি সমীক্ষা করা হয়। তার ফলাফল অনুযায়ী, ২০১৭ সালের মধ্যে এ রাজ্যে গুটখা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা।

তবে মোটের উপরে দেখা গিয়েছে, সরকারি নির্দেশিকার জেরে দক্ষিণ কলকাতার বেশ কয়েকটি জায়গায় বিক্রেতাদের উপরে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এক বিক্রেতাকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বলেন, “আমি সরকারের নির্দেশের বিষয়ে জানি। খবরের কাগজে পড়েছি। এ দিকে কোনও দিনই তেমন বড় দোকান ছিল না।” উত্তর কলকাতার থেকে এখানে বিক্রি কম হলেও যা হয়, সেটা যথেষ্টই বলে মত তাঁর। তাঁর বক্তব্য, “আগে গুটখা বিক্রি করতাম। এখন করি না। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ কী?” যদিও উত্তর কলকাতার বিভিন্ন দোকানে এখনও হামেশাই চোখে পড়ছে পাশাপাশি রাখা পানমশলা ও জর্দা। এবং দুইয়ের মিশেলে গুটখার রমরমা। এ ভাবে আইনের ফাঁক গলে কিছু মানুষ গুটখা খেয়ে নিজের ও সমাজের সর্বনাশ করছেন বলেই মত গুটখা না-খাওয়া সাধারণ মানুষের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

supriya tarafder gutkha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE