স্বপ্নপূরণ: ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে গোলের পর স্যামুয়েলকে নিয়ে সতীর্থদের উল্লাস। ছবি: এআইএফএফ
লাজং এফসি ২ : ইস্টবেঙ্গল ২
ফের স্বপ্নভঙ্গের আতঙ্ক ইস্টবেঙ্গলে।
সোমবার শিলংয়ে লাজং এফসি-র বিরুদ্ধে প্রথমার্ধে ডুডু ওমাগবেমির গোলের পরে অনেকেই হয়তো ভাবছিল, সহজে ম্যাচটা জিতে যাবে ইস্টবেঙ্গল। প্রথম লেগে ঘরের মাঠে লাজং-কে ৫-১ চূর্ণ করেছিল কাতসুমি ইউসা-রা। কিন্তু এ দিন ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা গোলের পরেই ভুলে গিয়েছিল যে, ম্যাচটা ৯০ মিনিটের। আর তাই ২০ মিনিটে ডুডু-র গোলের পরে আশ্চর্যজনক ভাবে ম্যাচ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ইস্টবেঙ্গলের দুই স্টপার সালামরঞ্জন সিংহ ও গুরবিন্দর সিংহের সামনে থেকে হেডে ফ্লিক করে গোল করল আইবানভা ধোলিং। হেডে করে কী ভাবে বল বিপন্মুক্ত করতে হয়, সালাম ও গুরবিন্দরের সেই প্রাথমিক জ্ঞানটাই নেই। তা সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গলের মতো দলে ওরা কী করে খেলছে সেটা ভাবতেই আমার অবাক লাগছে।
গোকুলম এফসি-র বিরুদ্ধেও প্রথমার্ধে ১-০ এগিয়ে গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। দ্বিতীয়ার্ধে রক্ষণের ভুলে দু’গোল খেয়ে হেরে মাঠ ছেড়েছিল। এ দিন অবশ্য হারতে হয়নি। কিন্তু গোকুলম ম্যাচের সেই ভুল থেকে যে কোনও শিক্ষাই নেয়নি লাল-হলুদ ডিফেন্ডার-রা, তা ফের প্রমাণিত।
ভাল ডিফেন্ডার হওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে, একই সঙ্গে প্রতিপক্ষের ফুটবলার ও বলের দিকে নজর রাখা। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুব্রত ভট্টাচার্য, তরুণ দে ও সত্যজিৎ ঘোষ-কে দেখেছি, স্ট্রাইকার হেড করার আগেই চিলের মতো ছোঁ মেরে বল বিপন্মুক্ত করত। অনুশীলনে দেখতাম, ক্লান্তিহীন ভাবে কয়েকশো হেড করত ওরা। প্রদীপদা (প্রদীপ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়) ও অমলদা (অমল দত্ত) অনুশীলনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উইঙ্গারদের দিয়ে দুই প্রান্ত থেকে ক্রমাগত সেন্টার করাতেন। আর পেনাল্টি বক্সের ভিতর থেকে সেই বলগুলো বিপন্মুক্ত করত মনাদা (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য), বাবলুদা (সুব্রত ভট্টাচার্য)-রা। ইস্টবেঙ্গলের ডিফেন্ডারদের দেখে মনে হয় না, ওরা এই ধরনের কোনও অনুশীলন করে। অথচ এরা নিজেদের পেশাদার ফুটবলার বলে। যদিও খেলার মধ্যে ন্যূনতম পেশাদারিত্বের ছাপ নেই। আমরা একটা ম্যাচ হারলে পরের দিনই ভুল শুধরে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতাম। প্রদীপদা, অমলদা বলতেন, ‘‘বড় দলের ফুটবলাররা একই ভুল দ্বিতীয়বার করে না।’’ লাল-হলুদ ডিফেন্ডারদের অবশ্য পুরোটাই ভুলে ভরা।
আরও পড়ুন: পেনাল্টি উপহার দিয়েছি, বলছেন হতাশ খালিদ
দ্বিতীয় গোলটার কথাই মনে করুন। পেনাল্টি বক্সের ভিতরে অকারণে স্যামুয়েল লালমুনপুইয়া-কে ফাউল করল মেহতাব সিংহ। ভাল ডিফেন্ডাররা কখনওই পেনাল্টি বক্সের মধ্যে জোড়া পায়ে ট্যাকল করার ঝুঁকি নেবে না। চেষ্টা করবে বিপক্ষের ফুটবলারকে বল নিয়ে পেনাল্টি বক্সের বাইরে পাঠাতে। অবাক হয়ে দেখলাম, স্যামুয়েল-কে লাথি মেরে ফেলে দিল মেহতাব। মনে হয় আমার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে মনাদা। লাজং-কে পেনাল্টি উপহার দিয়ে দলকে ডোবাল মেহতাব। ও এ দিন যা করল তা ভুল নয়, অপরাধ। যদিও ম্যাচের একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই ডুডু-ই অসাধারণ হেডে সমতা ফিরিয়ে লাল-হলুদের আই লিগ জয়ের সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখল। কিন্তু এই ভাবে বারবার ডিফেন্ডারদের ভুলে পয়েন্ট নষ্ট করলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভব নয়।
অবাক করল কোচ খালিদ জামিলের স্ট্র্যাটেজিও। মরণ-বাঁচন ম্যাচে কেন অর্ণব মণ্ডলের মতো অভিজ্ঞ স্টপারকে ও খেলাবে না? কেন ডুডু-র সঙ্গে মহম্মদ আল আমনার মতো বল প্লেয়ারকে ফরোয়ার্ডে খেলাবে? এই ইস্টবেঙ্গলে আমনা ও কেভিন লোবো-ই বল ধরে খেলতে পারে। ওরা দু’জন মাঝমাঠে থাকলে অনেক বেশি গোলের পাস পেতে পারত ডুডু, আনসুমানা ক্রোমা-রা। খালিদের ভুল স্ট্র্যাটেজিতে প্রথমার্ধ থেকেই মাঝমাঠের দখল নিল লাজং। অনবদ্য খেলল ওদের গোলরক্ষক নিধিনলাল।
ম্যাচটা দেখতে দেখতে ১৯৯৩ সালের কলিঙ্গ কাপ ফাইনালের কথা মনে পড়ছিল। আমি তখন ইস্টবেঙ্গলে। দুর্ধর্ষ টিম মোহনবাগানের। আই এম বিজয়ন, জো পল আনচেরি, চিবুজোর, বার্নার্ড, ক্রিস্টোফার, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো একঝাঁক তারকা। আমাদের দলে ভাইচুং ভুটিয়া, কার্লটন চ্যাপম্যান, কিরণ খোঙ্গসাইয়ের মতো অধিকাংশ জুনিয়র ফুটবলার। সকলে ধরে নিয়েছিল, ওরা আমাদের উড়িয়ে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন হবে। সেই উপেক্ষাই আমাদের জেদটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার জোড়া গোলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। সেই জেদ, বা লড়াইয়ের মানসিকতা ইস্টবেঙ্গলের এই ফুটবলারদের মধ্যে নেই। থাকলে হয়তো এ দিনই খেতাবের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যেত ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু এই ড্রয়ের ফলে এখন ফের তাকিয়ে থাকতে অন্য দলগুলোর দিকে। ফের লিগের জটিল অঙ্ক করে যেতে হবে। গোকুলমের বিরুদ্ধে হারের পরে লিখেছিলাম, ইস্টবেঙ্গলের প্রধান প্রতিপক্ষ ইস্টবেঙ্গলই। শিলংয়েও তার ব্যতিক্রম হল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy