জোয়াকিম লো-র ক্লাস। বৃহস্পতিবার মারাকানায়। ছবি: এএফপি
এখন বিষ্যুদবারের সকাল সাতটা! অন্য গোলার্ধের দেশ ব্রাজিলে ভরপুর শীতকাল পড়ে গিয়েছে বলেই বোধহয় সমুদ্রের ধারে নারকেলের জলটাও বরফ-শীতল। সেই কোপাকাবানা বিচ! কিন্তু সকাল-সকাল বিকিনির কোনও কাহিনি নেই। টি-শার্টেই যে কাঁপুনি দিচ্ছে। অথচ সেই ঠান্ডার মধ্যে জড়ো বেশ কিছু বিদেশি টিভি নেটওয়ার্কের লোকজন। ক্যামেরা নিয়ে যাঁরা বিচে তল্লাশি চালাচ্ছেন।
কোপাকাবানা-ধারের সাততারা হোটেলে তিনি উঠেছেন। প্রচণ্ড রেগে নিজের শোয়ে কাল বলেছেন, “মেসি একা কত করবে! ছেলেটার ওপর এমন অন্যায় চাপ। আমরা তো চল্লিশ ভাগ খেলাও খেলতে পারছি না। এমন চললে খুব শিগগির গুডবাই বিশ্বকাপ।” ভিড়টা কি সেই দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনাকে ধরার জন্য?
ইংরেজ টিভি কর্মী জানালেন, না। তাঁরা যাঁকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন, তিনি আর্সেন ওয়েঙ্গার। টিভি বিশেষজ্ঞ হিসেবে ব্রাজিলে আসা ওয়েঙ্গারকে কাল নাকি কোপাকাবানা তটে বিচ ভলিবল খেলতে দেখা গিয়েছে। একটামাত্র কাগজ সেই ছবি পেয়েছে। কোনও সাক্ষাৎকার নয়। বিষ্যুদবার সকাল থেকে প্রতিটি বিচ ভলিবলের মহল্লা তাই খোঁজা হচ্ছে... মিডিয়া জানতে চায় মুখ্যত দুটো প্রশ্নের উত্তর।
ফ্রান্স এ বার জার্মানদের বিরুদ্ধে বদলা নিতে পারবে কি?
হামেস রদ্রিগেজ থামাতে কী পরিকল্পনা হওয়া উচিত ব্রাজিল ডিফেন্সের? ওয়েঙ্গার নিজে হলে কী করতেন?
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, ওয়েঙ্গারের কোনও দেখা নেই। ব্রিটিশ প্রেসের কেউ এ বার অধৈর্য ভাবে বিলেতে ফোন ঘোরাতে শুরু করলেন।
মোরিনহোর এখানে আসার কোনও খবর আছে? এমনিতে বিশ্বকাপ চলাকালীন মোরিনহোর কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু প্রাক্-বিশ্বকাপ একটা শোয়ে কলম্বিয়া সাংঘাতিক প্রতিপক্ষ হতে পারে বলে পূর্বাভাস করেছিলেন। কোয়ার্টার ফাইনাল শুরুর মুখে। মোরিনহো তো এসে পড়তেই পারেন! এখানে না হোক, ফোর্তালেজায় কলম্বিয়ার জন্য।
রিও শেরাটন থেকে ঠিক ওই সময় মার্কিনবাসী এক বাঙালি জানালেন, তাঁর হোটেলে থিকথিক করছে ফরাসি মিডিয়ার ভিড়। ওটা ফ্রান্সের টিম হোটেল। সবাই ছুটছে করিম বেঞ্জিমার দিকে। ফোনে কথা বলতে বলতে দেখি, একটা বিশাল ট্রাকের মতো গাড়িকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে সামনে নেইমার, পিছনে স্কোলারির ছবি দিয়ে শোভাযাত্রার মতো চলেছে। গাড়িতে বাজছে ব্রাজিলের জাতীয় সঙ্গীত।
এ দিকে রিও ফুটপাথ আচমকাই যেন ভরে গিয়েছে জার্মান পর্যটকে। ফ্ল্যামেঙ্গো চত্বরের বাজার এলাকায় একটু-আধটু হাঁটলেই জার্মান শব্দ ভেসে আসছে— ডানকে শয়েন, বিট্টে শয়েন।
পৃথিবীর যেখানে যখনই ব্রাজিল খেলুক, রিও আসলে তার আধ্যাত্মিক আবাস। একে তো মারাকানায় কাল ইউরোপীয় গৃহযুদ্ধ। দেশঁর ফ্রান্স বনাম জোয়াকিম লো-র জার্মানি! ফুটবল ম্যাচের নামে মারকাটারি আর নীরব রক্তক্ষয়ী একটা সংঘর্ষ। তার ওপর আবার কয়েক ঘণ্টা বাদে নিজেদের রাজ্যপাট বাঁচিয়ে রাখতে নেইমার-সহ ব্রাজিল উদয় হচ্ছে ফোর্তালেজায়। মরার সময় এখন আছে রিওর!
শুক্রবার একই দিনে হলিউডের দু’টো ছবির মেগা ওপেনিংয়ের মতোই রুদ্ধশ্বাস ব্যাপার! কারা থাকবে, কারা কালই চলে যাবে? ফ্রান্স? জার্মানি? নাকি গোটা দেশকে গণশ্রাদ্ধের মধ্যে ফেলে দিয়ে ব্রাজিল? বিদেশে মেগা সিরিজের প্রথম টেস্ট শুরুর আগে যেমন রাহুল দ্রাবিড় বলতেন, “আর ধৈর্য থাকছে না, খেলাটা যে কখন শুরু হবে?” সেটাই যেন রিও তার ফুটবল-আত্মা দিয়ে বলছে, আর পারা যাচ্ছে না। শুক্রবার খেলাটা কখন শুরু হবে!
আয়োজনকারী দেশের জাতীয় অন্তরাত্মা পুরোটাই গচ্ছিত ব্রাজিল-কলম্বিয়া লড়াইয়ে। রিও-র ফুটপাথ থেকে শুরু করে গোটা দেশে যে পরিমাণ হলুদে রাঙা অবিশ্বাস্য ফুটবল-ডেকরেটিং হয়েছে, তাতে হামেস রদ্রিগেজের একটা বাঁ পায়ের ভলি অমাবস্যা নামিয়ে না দেয়, এই চিন্তায় গোটা ব্রাজিল আগাম উৎকণ্ঠিত।
কিন্তু ফোর্তালেজার লড়াইয়ের সঙ্গে আবেগ, চোখের জল আর সাম্বা যতই জড়িত থাক, প্রকৃত বিশ্বযুদ্ধ শুক্রবার মারাকানায়! এমন একটা জঙ্গি ঝঙ্কার এ দিন দু’দলের প্রস্তুতি আর প্রেস কনফারেন্স থেকে উঠে এল, তাতে মনে হচ্ছে কাল এক দিকে বোধহয় হিটলার আর এক দিকে নেপোলিয়ন গোলপোস্ট থেকে গোলপোস্টে সৈন্য পরিচালনা করবেন। হলেনই বা তাঁরা দু’টো ভিন্ন সময়ের।
ফরাসি গোলকিপারকে জিজ্ঞেস করা হল, এমন সব দাউদাউ করা ইতিহাসের পাতা জড়িত আছে দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্ক আর সংঘাতের সঙ্গে। ফুটবল তো সেখানে চুনোপুঁটি। চিন্তা হচ্ছে না, ইতিহাসের এমন ভার নিয়ে মাঠে নামতে হবে বলে? হুগো লরিস দলের অধিনায়কও। একটা গোটা দেশের স্বপ্নের বাহকের মতোই উত্তর দিলেন, “পুরনো পাতা দিয়ে কী হবে, কাল ইতিহাসের নতুন পাতা আমরা লিখব।” পাশে বসা দিদিয়ের দেশ।ঁ ব্রাজিল বিশ্বকাপে অন্তত পরিসংখ্যান বিচারে সফলতম কোচ। ক্যাপ্টেনের কথায় তিনি অনুমোদনের ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন।
লরিসকে দেখে মনে হচ্ছিল, রেফারি হুইসল দিলে টিম নিয়ে এখনই নেমে পড়তে রাজি আছেন। “আমরা তৈরি। এখন খেলাটা যখন শুরু হবে,” বললেন তিনি। গনগনে আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা যে, অনেক হয়েছে। এ বার জার্মানি, বদলার রক্ত চাটব আমরা!
কিন্তু নকআউট ম্যাচে জার্মানরা এত সহজ পাত্র নাকি যে বিপক্ষ আসবে আর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে! জার্মান কোচ দু’টো ট্যাকটিক্যাল মুভের জন্য ইতিমধ্যে টুর্নামেন্টে খুব বন্দিত হচ্ছেন। একটা টমাস মুলারকে দু’স্ট্রাইকার পিছনে লুকিয়ে ব্যবহার করা। মুলারের খেলাটা অনেকটা পাওলো রোসির মতো আঠারো গজে। কিন্তু তাঁকে এমন পিছনে রাখা হচ্ছে যে, বিপক্ষ ঘাড়ে চেপে মার্ক করতে পারছে না। দুই, টিম আক্রমণে উঠে যাওয়ার সময় গোলকিপার ম্যানুয়েল নয়্যারকে সুইপার হিসেবে ব্যবহার করা। প্রভাবটা দাঁড়াচ্ছে, বিপক্ষের এগারো জন। জার্মানির বারো জন।
এ হেন জোয়াকিম লো-কে নিয়ে তো জার্মান মিডিয়ার উচ্ছ্বাসে মগ্ন থাকা উচিত। আরও একটা বিশ্বকাপ গৌরবের দিকে তাঁর দলের এগিয়ে যাওয়ার দিন। অথচ লো-র নাম শুনলেই এখন চিড়বিড়ানি দেখাচ্ছে জার্মান মিডিয়া। আর সম্পর্কের উল্টো পিঠেও ঠিক ততটাই ঝাল! লো সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন কোনও কোনও সাংবাদিকের মুখের দিকে না তাকিয়ে।
ধন্য ধন্য হওয়া দূরে থাক, জার্মান মিডিয়া বলছে, লো হড়কালেন বলে। যা-তা টিম উনি আলজিরিয়ার বিরুদ্ধে খেলিয়েছেন। একটি জার্মান দৈনিক লিখেছে, দেখে মনে হচ্ছিল দেশকে কৃপা করে প্রত্যেকে জ্বর গায়ে খেলতে নেমেছে। লো এবং তাঁর টিম এই লেখায় প্রচণ্ড ক্ষেপেছেন। বছর পাঁচেক আগে জার্মান কোচ এমনই ক্ষেপে গিয়েছিলেন যখন ওয়েলসের কাছে জার্মানি হারার পর জাতীয় কাগজ লেখে, ‘এই গরমে বাইরে যাবেন ভাবছেন? প্লিজ এমন হোটেল বাছুন যেখানে টিভি নেই। কারণ টিভি থাকলে ভুলবশত আপনি জার্মান ফুটবল টিমের খেলা দেখে ফেলতে পারেন আর তখন আপনার ছুটির মেজাজ চৌপাট!’
ব্রাজিল বিশ্বকাপ অন্তরঙ্গ এবং বহিরঙ্গ, দুই মিলিয়েই এখন এমন উপত্যকায় পৌঁছেছে, যেখানে আর সমতল নেই। শুক্রবার থেকে শুধুই খাড়াই আর দমবন্ধ করে দেওয়া খাদ! মার্কিন টেলিভিশনে কাল রাতে একটা অদ্ভুত ছবি দেখলাম। আমেরিকার গোলকিপার টিম হাওয়ার্ডকে প্রশ্নকর্তা অনুনয় করছেন পরের বিশ্বকাপে থেকে যাওয়ার জন্য। হাওয়ার্ড যত বলছেন যে, মনে হয় না পারব বলে। পরের বিশ্বকাপে অনেক বয়স হয়ে যাবে আমার। তত প্রশ্নকর্তা অনুনয় করে যাচ্ছেন। সিএনএনের মতো চ্যানেল তাঁকে বলছে, প্লিজ, প্লিজ থাকুন।
পরিস্থিতি বোধহয় এমন যে, সহজ-স্বাভাবিক জিনিসগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। নইলে দিয়েগো মারাদোনা গত বার নিজে যখন কোচ ছিলেন, তখনও এমন আর্তনাদ করেননি। “আর্জেন্টাইন টিমকে বলছি, এটা কী হচ্ছে...কোনও মুভমেন্ট নেই...খেলার গতি বদলানো নেই... হেরে যাবে তো পরের ম্যাচেই... আর তখন পৃথিবী দুষবে বেচারা মেসিকে... কেউ ওর যন্ত্রণাটা বুঝবে না।” জিকো একই রকম ভয় পাচ্ছেন ব্রাজিলকে নিয়ে। “উন্নতি না করতে পারলে কাল ফুটন্ত কলম্বিয়াকে হারানোর আশা কোথায়,” বলছেন তিনি।
শুক্র আর শনি— ওবামা থেকে উল্টোডাঙার জুতোর কারখানার কর্মী! সবাই একই রকম মজে থাকবেন বিশ্বকাপের ভরপুর বক্স অফিসে। শুক্রবার থেকে আর কারও হারা-জেতার কাহিনি নেই যে। এ বার থেকে এক দল খাড়াইতে এগোবে। আর এক দল খাদে পড়ে মারা যাবে।
বিশ্বকাপ ১২ জুন থেকে গত কাল অবধি হয়ে শেষ হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার, ৪ জুলাই থেকে আর ফুটবল প্রতিযোগিতা হচ্ছে না। এ বার বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। প্রথম সংঘর্ষ— ওই যে লিখলাম, নেপোলিয়ন বনাম হিটলার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy