Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কঠিন পিচ মেনে নিয়েই বুক চিতিয়ে লড়াই

ড্রেসিংরুম পর্যন্তই বাকিরা থাকে। বাইশ গজে ব্যাটসম্যানের লড়াইটা সম্পূর্ণ তার একার! ক্রিজে দাঁড়ানোর সময় তার বংশলতিকা কেউ দেখবে না। বরং দেখবে বিপক্ষের ঝোড়ো সুইংয়ের সামনে সে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল কি না! ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র ঘুরে মনে হচ্ছে, এই সার সত্যটা বিলক্ষণ জানেন সাতাশের তরুণ। জানেন, সুহৃদরা যতই সঙ্গে থাকুন, দিনের শেষে লড়াইটা লড়তে হবে তাঁকেই। তাই লড়ছেন বুক চিতিয়ে। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো হিসেবে নয়, তাঁকে জিততে হবে এক কঠিন লড়াই। তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলছেন, “আমার যাত্রা মসৃণ নয়।”

বজবজের একটি রোড শোয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়।  ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

বজবজের একটি রোড শোয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

তাপস সিংহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৪ ০৪:২৮
Share: Save:

ড্রেসিংরুম পর্যন্তই বাকিরা থাকে। বাইশ গজে ব্যাটসম্যানের লড়াইটা সম্পূর্ণ তার একার!

ক্রিজে দাঁড়ানোর সময় তার বংশলতিকা কেউ দেখবে না। বরং দেখবে বিপক্ষের ঝোড়ো সুইংয়ের সামনে সে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল কি না!

ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র ঘুরে মনে হচ্ছে, এই সার সত্যটা বিলক্ষণ জানেন সাতাশের তরুণ। জানেন, সুহৃদরা যতই সঙ্গে থাকুন, দিনের শেষে লড়াইটা লড়তে হবে তাঁকেই। তাই লড়ছেন বুক চিতিয়ে। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো হিসেবে নয়, তাঁকে জিততে হবে এক কঠিন লড়াই। তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই বলছেন, “আমার যাত্রা মসৃণ নয়।”

নিন্দুকেরা অবশ্য অনেক কথাই বলছেন। যেমন বলছেন, অভিষেক এই কেন্দ্রে প্রার্থী হন, তা দলের একাংশই চায়নি। সেই কারণেই নাকি গোড়ার দিকে তেমন গতি পায়নি অভিষেকের নির্বাচনী প্রচার। এখন যদিও গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে সেই প্রচার যথেষ্ট গতিশীল। রীতিমতো পাল্টে গিয়েছে অভিষেকের দৈনন্দিন রুটিন।

এই যেমন গার্ডেনরিচের স্লটার হাউস রোড থেকে যে রোড শো একটু পরেই শুরু হবে, তার মেজাজটা বেশ উৎসব-উৎসব! ভিড়ের চেহারা বলে দিচ্ছে, প্রস্তুতি-পর্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে। দলনেত্রী ও প্রার্থীর ছবি আর স্লোগানে সাজানো হুড খোলা জিপের চালকের পাশের আসনে একটু পরেই জোড় হাতে দাঁড়াবেন যিনি, তিনি আপাতত ফুটপাথের পাশে রাস্তায় প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে। চারপাশে ঘিরে আছেন দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা। সাদা পোশাকে রোদ পড়ছে। কাঁধের দু’পাশ দিয়ে নেমেছে দলীয় উত্তরীয়। সাদা জামার বাঁ দিকে বুকের উপরে দলীয় ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন কর্মীরা।

নিন্দুকদের কথায় কান দিতে চাইছেন না তিনি। কপালের ঘাম মুছে মৃদু হেসে অভিষেক বলছেন, “আমি এই কথার সঙ্গে একমত নই। সবাই এককাট্টা হয়ে লড়ছেন। গোড়ার দিকে মাসখানেক কর্মিসভা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আগে তো সেনা তৈরি করতে হবে! তা ছাড়া, কে কোথায় দাঁড়াবেন তা দলনেত্রী ঠিক করবেন। যদি কেউ অন্য কিছু ভাবেন, সেটা তাঁর বা তাঁদের সমস্যা।” অভিষেক এ কথা বললেও অবশ্য তাঁর বাহিনীর ঐক্য নিয়ে এখনও ভিন্নমত কেউ কেউ।

এটা ঠিকই যে, তৃণমূল নেত্রী তাঁর পরিবারের সদস্যকে একেবারেই মসৃণ আসন দেননি। সে দিক থেকে দেখলে, এই কেন্দ্রের লাগোয়া দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্র যে অর্থে মসৃণ, ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্র সেই অর্থে নয়। তা সত্ত্বেও অভিষেককে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলে নেত্রী এই বার্তাই দল ও সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন যে, রীতিমতো লড়ে নিজের জায়গাটা করে নিতে হবে।

কিন্তু এই কঠিন পিচে সমস্যাটা শুধুই তো গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নয়। চোরাস্রোতও আছে নানা রকম।

যেমন, ‘প্রাক্তন তৃণমূল’ সোমেন মিত্রের ছেড়ে যাওয়া আসনে প্রচারের সময় উন্নয়নের স্লোগান তুলতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্বকে। ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল। সে বার ভোট কাটাকাটির প্রশ্ন ছিল না। এ বার আছে।

যেমন বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পালে সে ভাবে হাওয়া লাগেনি। সে বার বিজেপির ভোট ছিল ৩.৫৬ শতাংশ। কিন্তু এ বার যে মোদী হওয়া বইছে, সে কথা একান্ত আলোচনায় স্বীকারও করছেন তৃণমূল এবং সিপিএম নেতারা। আর এ কথা জানেন বলেই এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ (ববি) দাস বলেন, “আমি আসলে ডার্ক হর্স। আমার বড় সুবিধে হল, আমি এখানকার ভূমিপুত্র। বাইরের নই। সঙ্গে প্রবল মোদী হাওয়া বইছে। নতুন ভোটাররা কী করে, দেখবেন।” বিজেপির দিকে ভোটারদের একাংশের ঢলে পড়ার কথা স্বীকার করছেন কংগ্রেস প্রার্থী কামারুজ্জামান কামার-ও। তাঁর কথায়, “সিপিএমের হিন্দু ভোটের একটা অংশ বিজেপির দিকে যেতে পারে। বিজেপি ৫-৬ শতাংশ ভোট কাটবে তৃণমূলেরও।”

এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটার প্রায় ৩০ শতাংশ। হিন্দু ভোট কাটাকাটির আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই অভিষেক তাই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় রোড শো শুরুর আগে বলছেন, “আমাদের এই সরকার ইমাম ভাতা ও মোয়াজ্জেম ভাতা চালু করেছে। প্রতি জেলায় সংখ্যালঘু ভবন হয়েছে। হজ টাওয়ার হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার প্রকৃতই সংখ্যালঘু উন্নয়নের কথা ভাবে। অথচ, এত দিন সংখ্যালঘুদের ভোটব্যাঙ্ক ছাড়া কিছু ভাবা হয়নি।”

গুলাম মোল্লা লেন থেকে গোলাম রব লেন, মেহরুল্লা শাহ দরগা লেন, ফতেপুর ভিলেজ রোড, কারবালা রোড, বড়তলা, হাজি রতন লেন হয়ে বাঁ দিকে আক্রা রোড। চলছে তৃণমূলের সকালের রোড শো। প্রার্থীর জিপের আগে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মিছিল, জিপের পিছনেও মিছিল, আর তার পিছনে ছোট লরি বোঝাই সমর্থক। আর সব শেষে কলকাতা পুলিশের লাল রঙা টাটা সুমো। জিপ থেকে ঘোষণা চলছে, ‘আপনাদের কাছে আজ তৃণমূল প্রার্থী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আপনাদের দোয়া আর আশীর্বাদ চাইতে এসেছেন। তিনি নওজওয়ান... পড়ালিখা... মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো... তাঁর আশীর্বাদধন্য... তিনি পার্লামেন্টে গিয়ে আপনাদের কথা বলবেন...।’

তা হয়তো বলবেন। কিন্তু, চোরাস্রোতের তালিকার তো এখানেই শেষ নয়। যেমন রয়েছে সারদা-কাণ্ডের চোরাস্রোত। আমতলা-বারুইপুর রোডে দাঁড়িয়ে স্থানীয় জনতা একটি সাদা রঙের চারতলা বাড়ি দেখিয়ে বলতে থাকে, “এই দেখুন, এটাও সারদার বাড়ি ছিল। রাতারাতি এটার ভোল পাল্টে, কম্পিউটার, সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কাজে এলাকার কিছু নেতাও ছিলেন।” এ কেন্দ্রের নানা প্রান্তের নানা স্বর জানিয়ে দেয়, সারদা বা তার মতো আরও অনেক সংস্থায় টাকা রেখে কী ভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁরাই তো ভোটের জনতা! ফলে আশঙ্কার চোরাস্রোতও থাকছে!

সে সব আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই যেন পাল্লা দিয়ে ছুটছে অভিষেকের প্রচারপর্ব। গভীর রাতে শুলেও বিছানা ছাড়ছেন ভোর সাড়ে ৫টা নাগাদ। তৈরি হয়ে সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত রোড শো, সভা। এর পর ব্লক সভাপতি ও অন্যদের সঙ্গে বৈঠক। বিকেল ৪টে থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ফের রোড শো। সাড়ে ৬টা-পৌনে ৭টা থেকে জনসভা। একের পর এক। চলছে রাত ১০টা পর্যন্ত। এর পর দলীয় কর্মীদের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক। এই কেন্দ্রের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত তৃণমূল প্রার্থীর এটাই এখন দৈনন্দিন রুটিন।

অভিষেকের প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএম প্রার্থী আবুল হাসনাত পেশায় চিকিৎসক। দলের অস্ত্র তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি। দীর্ঘ ২০ বছর ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের সার্জন ছিলেন হাসনাত। তার পরের আট বছর প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করছেন। এলাকায় তাঁর দয়ালু ভাবমূর্তি আছে। অত্যন্ত কম টাকায় রোগী দেখা, কেউ ভিজিটের টাকা দিতে না পারলে উল্টে তাঁর হাতে বাসভাড়ার টাকা দিয়ে দেওয়া এলাকায় ঘুরলে এমনতর নানা কথা শোনা যায় ‘ডাক্তারসাহেব’-এর সম্পর্কে। আমতলায় দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে হাসনাত বলেন, “আমরা আশাবাদী। কেন্দ্রের অনেক বেশি ভিতরে ঢুকছি। ভোটারদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলছি, হাত মেলাচ্ছি। তৃণমূলে আন্ডারকারেন্ট বেশি, সেটাই আমাদের অ্যাডভান্টেজ।”

‘অ্যাডভান্টেজ’-এর কথা শোনান পিডিএস প্রার্থী সমীর পুততুণ্ডও। বলেন, “আমার কেন্দ্রে বিজেপির ভোটের পালে হাওয়া লেগেছে। আর তার সঙ্গে জুড়েছে আমার টান। সিপিএম আর তৃণমূলের ভোটের হিসেব গুলিয়ে গিয়েছে।”

গুলিয়ে যাচ্ছে অবশ্য আরও অনেক হিসেব-নিকেশ। সে আরও লম্বা কাহিনি। ডায়মন্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র, তার প্রতিটির নানা কিসিমের হিসেব-নিকেশ!

তবু স্করপিও-র সামনের আসন থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে সাতাশের যুবা বলছেন, “আমার যাত্রা মসৃণ নয়। তবু আমি লড়ে যাব। ‘দিদি’ আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। লড়াইটাই আসল!”

তিনি জানেন, ড্রেসিংরুমে উৎসাহ দিতে সতীর্থরা থাকেই। কিন্তু পিচের দিকে ব্যাটসম্যান এগিয়ে যায় একা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

diamon harbour tapas sinha lok sabha election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE