খাগড়াগড় বিস্ফোরণে অভিযুক্ত শাহনুর আলমকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আদালতে। সঙ্গে রয়েছে জামাত সদস্য সন্দেহে ধৃত নুরজামাল হকও (পিছনে)। শনিবার গুয়াহাটিতে। ছবি:উজ্জ্বল দেব।
বর্ধমানের খাগড়াগড়ে তৈরি হওয়া আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস)-র একটা বড় অংশ মজুত করা হয়েছে অসমেই। শনিবার এমনই দাবি করল অসম পুলিশ। সেই সঙ্গে তাদের দাবি: বাংলাদেশে আলফা-র পরেশ গোষ্ঠীর সঙ্গে জামাতুল মুজাহিদিনের একটি জরুরি বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে অস্ত্র ও নাশকতায় পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যাপারে সহমত হয়েছে দু’পক্ষের নেতারাই। অসমের পক্ষে যা বড় বিপদ বলে মনে করছে পুলিশ।
নলবাড়ি থেকে ধৃত, খাগড়াগড়-কাণ্ডে অভিযুক্ত জামাত-জঙ্গি শাহনুর আলমের ১৪ দিন পুলিশি হেফাজতের মেয়াদ এ দিনই শেষ হয়। কামরূপ মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তাকে হাজির করানো হলে শাহনুরকে বিচারক জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
শাহনুরকে গ্রেফতার করেছিল অসম পুলিশ। তবে খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র গোয়েন্দারা অসম পুলিশের হেফাজতেই শাহনুরকে দফায় দফায় জেরা করেছেন। ঠিক ছিল, অসম পুলিশের হেফাজতে শাহনুরের থাকার মেয়াদ শেষ হলে তাকে নিজেদের হেফাজতে নিতে এনআইএ আবেদন করবে।
সেই মতো এ দিন কলকাতার নগর দায়রা আদালতে এনআইএ-র পক্ষ থেকে শাহনুরকে হেফাজতে নিতে আবেদন জানানো হয়। খাগড়াগড়ে জামাত জঙ্গিদের জড়িত থাকার বিষয়টি জেনে অসম পুলিশ শাহনুরেরও আগে বরপেটা থেকে গ্রেফতার করে শহিকুল ইসলাম ওরফে আবদুল্লা এবং রফিকুল ইসলামকে। শাহনুরের পাশাপাশি ওই শহিকুল ও রফিকুলকেও নিজেদের হেফাজতকে নিতে কলকাতার নগর দায়রা আদালতে আবেদন করে এনআইএ। বিচারক এনআইএ-র ওই আবেদন শুনে আগামী ৩ জানুয়ারির মধ্যে শাহনুর-সহ তিন জনকে কলকাতার নগর দায়রা আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দিয়েছেন।
কলকাতার আদালতের ওই নির্দেশ কামরূপ সিজেএম আদালতে পৌঁছনোর পর শাহনুর ও বাকি দু’জনকে কলকাতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এনআইএ-র দাবি, বাংলাদেশ থেকে আসা টাকা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জঙ্গি ডেরায় পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল শাহনুর।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জেরায় শাহনুর জানিয়েছে, বর্ধমানে তৈরি হওয়া আইইডি-র অনেকগুলিই অসমের নলবাড়ি ও বাক্সা জেলায় আনা হয়েছে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের আগেই আইইডিগুলি আনা হয়েছিল। রাজ্যে শাহনুরের মাথার উপরে থাকা দুই জামাত নেতার হেফাজতে সেগুলি লুকিয়ে রাখা হয়।
অসম পুলিশের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর এডিজি রামমোহন সিংহ জানান, স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের বিশেষ অভিযানকারী দল আপাতত আইইডিগুলির খোঁজে নলবাড়ি ও বাক্সায় তল্লাশি চালাচ্ছে। বাক্সার শালবাড়ি থেকে গ্রেফতার হওয়া আরও এক সন্দেহভাজন
জামাত সদস্যকে শাহনুরের সঙ্গেই এ দিন আদালতে তোলা হয়। নুরজামাল হক নামে ওই সন্দেহভাজন জেহাদিকে ১৪ দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ।
এডিজি জানান, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে পরেশ বরুয়ার ঘনিষ্ঠ দুই নেতা জামাতুল মুজাহিদিনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। অসমে নাশকতা ঘটানোর ক্ষেত্রে জামাত ও আলফার হাত মেলানোর বিষয়টিতে পুলিশ উদ্বিগ্ন। গোয়েন্দাদের দাবি, দু’পক্ষের মধ্যে অস্ত্র বিনিময়ের ব্যাপারে গোপন চুক্তি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এর আগেও জেহাদিদের সঙ্গে আলফার যোগাযোগ থাকার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। যদিও খোদ পরেশ বরুয়া ওই অভিযোগ উড়িয়ে দেন।
অসম পুলিশের ডিজি খগেন শর্মার বক্তব্য, “বাইরে থেকে জেহাদি নেতারা অসমে যখনই ঢুকেছে তখনই উত্তপ্ত হয়েছে নামনি অসম।” এডিজি জানান, সীমান্ত ঘেঁষা সংবেদনশীল এলাকাগুলিতে ইউনিফায়েড কমান্ড-এর অধীনে বিশেষ কম্যান্ডো অভিযান চালানো হবে। এই ব্যাপারে এসএসবি ভুটান সরকারের সঙ্গেও কথা বলছে।
অসমের জামাত চাঁই শাহনুর-সহ তিন সন্দেহভাজন জেহাদিকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চেয়ে আবেদন জানানোর পাশাপাশি এনআইএ এ দিন খাগড়াগড়-কাণ্ডে অভিযুক্ত দু’জনকে ফের নিজেদের হেফাজতে পেয়েছে। রাজিয়া বিবি ও হাসেম মোল্লা কিছু দিন যাবৎ জেলে ছিলেন। এ দিন কলকাতার নগর দায়রা আদালতের বিচারক তাদের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এনআইএ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাসেম ছিল প্রেসিডেন্সি জেলে এবং শিশুসন্তানকে নিয়ে রাজিয়া ছিল প্রেসিডেন্সি জেলেরই মহিলা সংশোধনাগারে বন্দি। যদিও তার আগে দু’জনেই এনআইএ হেফাজতে ছিল। এনআইএ তাদের দফায় দফায় জেরাও করেছে। তা হলে ফের তাদের এনআইএ হেফাজতে নেওয়ার প্রয়োজন হল কেন?
এনআইএ-র এক শীর্ষকর্তা এ দিন বলেন, “তদন্তে এমন কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য সম্প্রতি উঠে এসেছে যে, ফের ওই দু’জনকে হেফাজতে নেওয়ার প্রয়োজন হল আমাদের। এক নয়, একাধিক কারণে।” কী সেই কারণ, ওই অফিসার সেটা খোলসা করে বলতে না চাইলেও একটি সূত্রের খবর, বর্ধমান জেলায় জঙ্গি মডিউল বা গোষ্ঠীর আরও কয়েক জন সদস্য সম্পর্কে কিছু তথ্য গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। সেই সব তথ্য যাচাই করা হবে হাসেম ও রাজিয়াকে দিয়ে। তা ছাড়া, এনআইএ-র নজরদারিতে বিশেষ এক জন রয়েছে বলেও কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি) সূত্রে জানা গিয়েছে। গোয়েন্দাদের একাংশের বক্তব্য, রাজিয়া ও হাসেমকে দিয়ে ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করিয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চায় এনআইএ।
গত ২ অক্টোবর খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থল থেকেই রাজিয়া বিবি ধরা পড়েছিল। বিস্ফোরণে নিহতদের অন্যতম, শাকিল আহমেদের স্ত্রী, নদিয়ার করিমপুরের বাসিন্দা এই রাজিয়া ওরফে রুমি। আর হাসেম মোল্লাকে ঘটনার দু’দিন পর পূর্বস্থলী থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এ দিন কলকাতার নগর দায়রা আদালতে এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামল ঘোষ দাবি করেন, মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া মাদ্রাসা এবং খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া বেশ কিছু নথি যাচাইয়ের জন্য ও তার উৎস জানতে রাজিয়া ও হাসেমকে নতুন করে জেরা করা জরুরি।
এ দিন কলকাতার নগর দায়রা আদালতের বিচারকের কাছে একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকষর্ণ করেন এনআইএ-র আইনজীবী। তিনি জানান, খাগড়াগড় কাণ্ডে প্রথমে গ্রেফতার হওয়া রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবির বিরুদ্ধে বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনে (ইউএপিএ) মামলা রুজু করা হয়েছে। কিন্তু এ বার আরও পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে ওই আইনে। ফলে, আইন অনুযায়ী, ওই পাঁচ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও চার্জশিট পেশ করার মেয়াদ ১৮০ দিন পর্যন্ত পাবেন তদন্তকারীরা। জিয়াউল হক, আলিমা বিবি-সহ ওই পাঁচ জনকে ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠিয়েছে আদালত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy