Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

খালি বলত আরও টাকা দরকার, বুঝতাম না কেন: পিয়ালি

ব্যাগটা নিজের হাতে গুছিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই। কিন্তু জানতেন না সেই ব্যাগ নিয়ে দেবযানীর সঙ্গে পালিয়ে যাবেন তাঁর স্বামী! অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পাওয়া গেল পিয়ালি সেনকে। সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী। বাগুইআটিতে দু’কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে দুই ছেলেমেয়ে আর মাকে নিয়ে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। দিন কয়েক হাজতবাসের পরে সবে বাড়ি ফিরেছেন পিয়ালিদেবী। সঙ্গে ক্যামেরা নেই, এই শর্তে সামনে বসে কথা বলতে রাজি হয়েছিলেন।

সুনন্দ ঘোষ ও শুভাশিস ঘটক
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ০৩:৫২
Share: Save:

ব্যাগটা নিজের হাতে গুছিয়ে দিয়েছিলেন তিনিই। কিন্তু জানতেন না সেই ব্যাগ নিয়ে দেবযানীর সঙ্গে পালিয়ে যাবেন তাঁর স্বামী!

অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পাওয়া গেল পিয়ালি সেনকে। সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের দ্বিতীয় স্ত্রী। বাগুইআটিতে দু’কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাটে দুই ছেলেমেয়ে আর মাকে নিয়ে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়েছে তাঁর। দিন কয়েক হাজতবাসের পরে সবে বাড়ি ফিরেছেন পিয়ালিদেবী। সঙ্গে ক্যামেরা নেই, এই শর্তে সামনে বসে কথা বলতে রাজি হয়েছিলেন। সামনে এলেন মুখে কালো ওড়না ঢেকে। ‘ক্যামেরা নেই’ বা ‘মোবাইলেও ছবি তোলা হবে না’ গোছের আশ্বাসে কোনও কাজ হয়নি। চোখ বড় বড় করে বলেন, “কী ভয়ে থাকি বলে বোঝাতে পারব না। মনে হয় এই বুঝি ফ্ল্যাটে এসে হুমকি দিয়ে গেল।”

কারা? বড় বড় চোখ বলে উঠল, “আমাকে দিয়ে কেন বলাচ্ছেন? আপনারা জানেন না কারা?”

টানা দু’ঘণ্টা কথা বললেন পিয়ালি। সুদীপ্তর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কথা। সংসারের কথা। ছেলেমেয়ের কথা। দর্শনে এমএ পাশ করা পিয়ালির সঙ্গে বছর চল্লিশের সুদীপ্তর বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। প্রথম স্ত্রী মধুমিতা নিজের ছেলেমেয়ে শুভজিৎ আর প্রিয়ঙ্কাকে নিয়ে সরে গেলেন। সুদীপ্ত বিয়ে করলেন পিয়ালিকে। পিয়ালির অবশ্য দাবি, তিনিই সুদীপ্তর প্রথম বৈধ স্ত্রী। তাঁর কথায়, “আমিই স্ত্রী। সব পক্ষের। ওর সুসময় আর দুঃসময়ে আমিই তো ওর পাশে থেকেছি।”

কেমন ছিল সুদীপ্তর জীবন?

পিয়ালিদেবীর কথায়, ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভালই ছিল। শুরুর দিকে সুদীপ্ত শুধু জমি কেনাবেচার কাজই করতেন। সল্টলেকে চার হাজার টাকা ভাড়ার একটা ফ্ল্যাট আর একটা পুরনো অ্যাম্বাসাডর গাড়িই তখন সম্বল। জামাকাপড় থেকে শুরু করে সব কিছুই নিজের হাতে কিনতেন পিয়ালি। সাধারণ মানের জামাকাপড়, জুতোই কেনা হত। তেমন কোনও বিলাসিতা ছিল না। নিরামিষ সেদ্ধ তরিতরকারি খাওয়া হতো। মদ খেতেন না সুদীপ্ত। নেশা বলতে সিগারেট। কিন্তু ২০০৮ সালের পর থেকে পিয়ালি লক্ষ করতে থাকেন, নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল সুদীপ্তর। বেশির ভাগ দিনই বাড়ি ফিরতেন না। সারদার ব্যবসা চড়চড় করে ফেঁপে ওঠা, মিডিয়া ব্যবসায় হাত দেওয়া সবই ওই সময় থেকে শুরু।

পিয়ালি বলতে থাকেন, “আমি জিজ্ঞেস বললেই বলত, ‘এত কাজ। ও তুমি বুঝবে না।’ মাঝেমধ্যেই বলত, ‘আরও টাকার দরকার।’ বুঝতাম না কেন?” এও বুঝতেন না, কেন তাঁর স্বামীর মালিকানাধীন সংবাদপত্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এলেও তাঁকে বা তাঁর ছেলেমেয়েকে ডাকা হয়নি। বুঝতেন না কেন সমস্যায় পড়লেও সে কথা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করতেন না সুদীপ্ত। শুধু জানতেন, নিজের চারপাশে একটি স্বতন্ত্র বলয় তৈরি করে রাখতেন। সেই বলয়ের মধ্যে আর যারই হোক, পিয়ালির ঢোকার অনুমতি ছিল না।

পিয়ালির দাবি, তিনি দেবযানীর কথা জানতেনই না। “পরে যখন শুনলাম ও আমার স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াত, কোম্পানিতে আমার স্বামীর পরেই ওর জায়গা ছিল, আমি তো অবাক! শুভজিতকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা সবাই যখন দেবযানীর কথা জানতে, আমাকে কেন জানাওনি?” পিয়ালির কথা অনুযায়ী, নিজের দফতরে কী ঘটত, কারা চাকরি করতেন, কাকে টাকা দিতেন সুদীপ্ত তার বিন্দুবিসর্গ জানাননি ওঁকে। এমনকী সল্টলেকে সুদীপ্তর ঝাঁ চকচকে নতুন অফিসে এক দিনের জন্যও তিনি যাননি। শুধু সেই অফিসের বাছাই করা দু’এক জন কর্মী এসে তাঁকে দিয়ে কাগজে সই করিয়ে নিয়ে যেতেন। কী সেই কাগজ? তাও জানতেন না তিনি। তাঁর দাবি, “স্বামী বলতেন, আমি সই করে দিতাম। পড়েও দেখিনি। ওকে তো চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছি।”

তবু সেই বিশ্বাসের ফাঁকেই গত তিন-চার বছর শুরু হয়েছিল বিক্ষিপ্ত অশান্তি। মাঝেমধ্যেই টাকাপয়সা নিয়ে খটাখটি হত। এফডি ব্লকে বিশাল ফ্ল্যাট, বাড়ির তলায় টয়োটা কোরোলা, মিৎসুবিশি পাজেরো এবং মাহিন্দ্রা স্করপিও দাঁড়িয়ে থাকলে কী হবে, সাধারণ সংসার খরচের টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলা বাধত। পিয়ালি বলেন, এত বড় ব্যবসা সত্ত্বেও কেন টানাটানি, সেটা বুঝতে পারতেন না তিনি। তাঁর কথায়, স্ত্রী হিসেবে কোনও দিনই বিরাট কিছু চাহিদা ছিল না তাঁর। সুদীপ্ত মাসে ৫০ হাজার টাকা দিতেন সংসারের খরচ বাবদ। এ ছাড়া ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে পিয়ালি অনেক বারই বলেছেন, একটা স্থায়ী বাসস্থানের কথা। সেই কথা রেখে এফডি ব্লকের ফ্ল্যাট কেনেন সুদীপ্ত।

গত বছর এপ্রিলে সুদীপ্ত বেরিয়ে যান ‘ট্যুরে’। বাস্তবে দেবযানীর সঙ্গে কলকাতা থেকে পালান তিনি। পরে কাশ্মীর থেকে ২৩ এপ্রিল ধরা পড়েন দু’জনে। পিয়ালির কথায়, “আমিই তো ব্যাগ গুছিয়ে দিলাম। ও বলে গেল কাজে যাচ্ছি।” তার পরে পিয়ালি ছেলেমেয়েদের নিয়ে মুম্বই বেড়াতে যান। অন্য বারের মতোই ফোনে সুদীপ্তর সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল। দিন কয়েক পর থেকে আর ফোন মিলছিল না। তখন “ভাই ফোন করে জানাল, ওকে গ্রেফতার করা হয়েছে।”

কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যেই কেঁদে ফেলছেন পিয়ালি। একদিন স্বামী-সন্তান সহ মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে ছুটি কাটিয়েছেন। এখন মোবাইলে ২০ টাকা ‘রিচার্জ’ করাতে আত্মীয়দের অনুরোধ করতে হচ্ছে। এপ্রিল মাসে সল্টলেকের বাড়ি পুলিশ সিল করে দেওয়ার পরে ছেলেমেয়েকে নিয়ে মায়ের ফ্ল্যাটে চলে আসেন। শীতে ছেলেমেয়ের গায়ে পরানোর মতো জামা ছিল না। “লোকের কাছে চেয়ে শীতের জামাকাপড় পরিয়েছি ওদের। দু’জনেরই স্কুল যাওয়া বন্ধ। আমি নিজে মেয়ের স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি। উনি দেখা করেননি।”

দিন কয়েক আগে স্বামী-স্ত্রীর আচমকা দেখা ব্যাঙ্কশাল কোর্টের লকআপে। “বিশ্বাস করুন, ওকে দেখে চিনতেই পারিনি। কী চেহারা ছিল আর কী হয়েছে!” সুদীপ্তকে কোর্ট লকআপে যখন ঢোকানো হল পিয়ালি প্রথমে একবার মুখ তুলে নামিয়ে নিয়েছিলেন। পাশ থেকে শুভজিৎই আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলে ওঠেন, “বাবা।”

এত লাঞ্ছনার পরেও পিয়ালি ফিরে পেতে চান সুদীপ্তকে। বলেন, “ও-ই তো শেষ সম্বল।” এমন অনেক আত্মীয়-বন্ধু আছেন, যাঁরা এক সময় সাহায্য পেয়েছেন। আজ তাঁরাই মুখ ফিরিয়েছেন। জামিন পাওয়ার পরে স্ত্রীর কাছে ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা যে সুদীপ্তর নেই, তা আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন পিয়ালি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

saradha case sunanda ghosh shubhashis ghatak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE