রাজ্য সরকারের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে শেষ দফার ভোটের ঠিক আগে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট।
সিবিআই তদন্তের বিরোধিতায় রাজ্য সরকারের বক্তব্য ছিল, তাদের পুলিশ তদন্তে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। সেই দাবি খারিজ করে শীর্ষ আদালত আজ জানিয়ে দিয়েছে, আসল ষড়যন্ত্রের তদন্তে রাজ্য পুলিশ এক পা-ও এগোতে পারেনি। সারদা-র টাকা কোথায় গেল, তার এখনও কোনও হদিস মেলেনি। সারদার টাকায় কেনা সম্পত্তির পুরোপুরি হদিস পেতেও ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট)।
এই পরিস্থিতিতে কেন সিবিআই তদন্ত প্রয়োজন তার ব্যাখ্যা করে বিচারপতি টি এস ঠাকুর ও বিচারপতি সি নাগাপ্পনের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, এই ১০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে ২৫ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। জড়িত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতারা। সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, কোম্পানি নিবন্ধকের মতো সংস্থাগুলির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তা ছাড়া, কেলেঙ্কারির জাল একাধিক রাজ্যে ছড়িয়ে। ফলে সিবিআই-ই তদন্ত করার পক্ষে উপযুক্ত সংস্থা।
রাজ্য পুলিশ সারদার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, মামলা নথিভুক্ত করা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাল কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেও শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, রাজ্য পুলিশ কোথায় ব্যর্থ হয়েছে প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন হল, যাঁরা অসন্তুষ্ট তাঁদের আস্থা অর্জন করা গিয়েছে কি না। এ ব্যাপারে যা যা করা দরকার ছিল রাজ্য পুলিশ তা করেছে কি না সেই প্রশ্নে না গিয়েও আমরা বলতে পারি, সারদার টাকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। সারদার টাকা এমনকী বিদেশেও পাচার হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে শীর্ষ আদালত বলেছে, সিবিআই-কে তদন্ত করতে দেওয়ার এটাও একটা কারণ।
রাজ্যে পঞ্চম তথা শেষ দফা ভোটের প্রচার পর্ব শেষ হওয়ার ঠিক আগের দিন সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ভোটারদের উপরে ভালই প্রভাব ফেলবে বলে অনেক রাজনৈতিক নেতার মত। শাসক দলের অনেক নেতার সঙ্গেই যে হেতু সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের ওঠাবসা ছিল এবং তাঁরা এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে, সে হেতু তৃণমূলই বড় ধাক্কা খেল বলে মনে করা হচ্ছে। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য আজ দাবি করেছেন, সিবিআই কেন, সিবিআইয়ের বাবা তদন্ত করলেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই। তাঁর ভয় পাওয়ারও কোনও কারণ নেই। মমতার মন্তব্য, “আমরা বেঁচে গেলাম। আমাদের কী যায় আসে! ওদের মুখে চুনকালি পড়ুক। আমার আর দায়িত্ব থাকল না। আই অ্যাম টোটালি সেফ। মাই গভর্নমেন্ট ইজ সেফ।”
অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও বলেন, “দু’দিন পরেই রাজ্যে শেষ দফায় ভোট, যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে রায় বেরোলেও আমরা সুপ্রিম কোর্টের কথা নিশ্চয় মানব।” তা হলে রাজ্য সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছিল কেন? জবাব না দিয়েই চলে যান অর্থমন্ত্রী। তা ছাড়া, সিবিআই তদন্তের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের সমালোচনাই করেছেন অমিতবাবু। তাঁর কথায়, “নেতাই বা নন্দীগ্রামের মতো অনেক মামলা সিবিআইয়ের হাতে রয়েছে। কিন্তু সে সব অনুসন্ধানের কোনও ফল আমরা দেখতে পাইনি।”
পাশাপাশি, শুধু সারদা নয়, সঞ্চয়িতা থেকে শুরু করে সমস্ত লগ্নি সংস্থার কারবারকেই সিবিআই তদন্তের আওতায় আনার আর্জি জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, ১৯৮০ সালে বাম আমলে সঞ্চয়িতা দিয়ে এই কেলেঙ্কারি শুরু হয়েছিল। সারদার কারবারও শুরু হয়েছিল তাদের সময়েই। কিন্তু এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) রিপোর্ট যে বলছে, তৃণমূল আমলেই সারদা-সহ লগ্নি সংস্থাগুলির রমরমা? অমিতবাবুর জবাব, “সেটা দেখার দায়িত্ব তদন্তকারী সংস্থার।” আর বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, “কান টানলেই মাথা আসবে। বড় বড় নেতারা কেউ বাদ যাবেন না।”
আজকের রায়ের ফলে সারদার বিরুদ্ধে যাবতীয় মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে চলে যাচ্ছে। শুধু সারদা নয়, রাজ্যে অন্য যে সব লগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা চলছে, তাদের কার্যকলাপ নিয়েও তদন্ত করবে সিবিআই। এমনকী, যে সব মামলায় সিট ইতিমধ্যেই চার্জশিট দিয়েছে, প্রয়োজন হলে সেগুলিও খতিয়ে দেখতে পারবে তারা।
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি ওড়িশা, অসম ও ত্রিপুরাতেও তদন্ত করবে সিবিআই। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে দেওয়ার জন্য শীর্ষ আদালতে মামলা করেছিলেন প্রতিম সিংহরায়, আবু আব্বাসউদ্দিন এবং সুব্রত চট্টরাজ। একই ভাবে ওড়িশার ৪৪টি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চেয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন অলোক জেনা। যার মধ্যে সারদা-সহ ১৭টি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গের। যার অর্থ, শুধু সারদা নয়, রাজ্যের অধিকাংশ অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধেই সিবিআই তদন্ত হবে।
সোমবার রাজ্যে ১৭টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ। যার মধ্যে রয়েছে কলকাতা ও দুই ২৪ পরগনার সব ক’টি আসন। যে আসনগুলিতে গত কয়েকটি ভোটেই তৃণমূলের একচ্ছত্র প্রভাব। প্রশ্ন হল, সেখানে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কতটা প্রভাব ফেলবে? শাসক দলের ভোটব্যাঙ্ক কি ধাক্কা খাবে? অনেকের মতে, সেই আশঙ্কা থেকেই সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার বারবার অভিযোগ তুলেছিল, এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়েই এই মামলা করা হয়েছে। কিন্তু আবেদনকারীদের কৌঁসুলি বিকাশ ভট্টাচার্যের যুক্তি, “যখন মামলা হয়েছিল, তখন ভোট ছিল না। রাজ্য সরকারই বারবার মামলা দীর্ঘায়িত করায় ভোট চলে এসেছে। আর বিচারপতিরাই বলেছেন, এই কেলেঙ্কারিতে রাজনৈতিক ক্ষতি হওয়ার থাকলে তা হয়ে গিয়েছে।”
কোন কোন নেতা সারদার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কে কত টাকা পেয়েছেন, তার তালিকা মুখবন্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেয় সিট। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে তিন বার হলফনামাও জমা দেয় তারা। কিন্তু আদালত তাতে খুশি হতে পারেনি। বিকাশবাবু বলেন, “প্রত্যেকবারই সেই হলফনামা থেকে আমরা দেখাতে পেরেছি, আসল তদন্ত কিছুই হয়নি। কাউকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে।” আবেদনকারীদের আরেক আইনজীবী অশোক ভাবের অভিযোগ, “তৃণমূল এমন কয়েক জনকে রাজ্যসভার সাংসদ করে পাঠিয়েছে, যাঁরা তেমন কোনও বড় মাপের কেউ নন। তবে সারদার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এর থেকেই স্পষ্ট শাসক দল তথা সরকারের সঙ্গে সারদার একটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক ছিল।”
আজকের রায়ের পরে সারদা কমিশনের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন উঠে গেল। সারদা কেলেঙ্কারির উৎস সন্ধানের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের সুরাহা দিতে প্রাক্তন বিচারপতি শ্যামল সেনের নেতৃত্বে এই কমিশন গড়েছিল রাজ্য সরকার। কমিশন ইতিমধ্যে বেশ কিছু লগ্নিকারীকে টাকা ফেরতও দিয়েছে। শীর্ষ আদালত এ দিন জানিয়েছে, ইডি নিজেদের মতো সারদার বেআইনি সম্পত্তি আটক করার কাজ করবে। রাজ্য পুলিশ সাহায্য করবে সিবিআই-কে। কাজ চালিয়ে যাবে শ্যামল সেন কমিশনও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “এ বার সিবিআই-কে টাকা ফেরত দিতে হবে। আর তা হলে কংগ্রেস, বিজেপি সিপিএমের ঘরে ঘরে মানুষ যাবে আর টাকা ফেরত চাইবে। আমি সে দিনটার দিকে তাকিয়ে থাকব।” বিকাশবাবুর অবশ্য দাবি, “টাকা ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব সিবিআইয়ের নয়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy