লালগড়ে নেতাইয়ের গণহত্যায় ফেরারদের গ্রেফতার করে সিবিআই-কে সাহায্য করবে বলে কথা দিয়েছিল রাজ্য পুলিশ। কিন্তু সেই রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধেই অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে এ বার কলকাতা হাইকোর্টের শরণাপন্ন সিবিআই!
ওই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার অভিযোগ, নেতাই কাণ্ডের তদন্তভার তাদের হাতে রয়েছে ঠিকই। কিন্তু ধৃতদের তাদের হেফাজতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অভিযুক্তদের জেরা করে অস্ত্র উদ্ধারের যে-সম্ভাবনা ছিল, সেই কাজ ব্যাহত হচ্ছে ভীষণ ভাবে। বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের এজলাসে সিবিআইয়ের এই মামলার শুনানি হয়েছে। সিবিআইয়ের আশা, চলতি সপ্তাহেই এই ব্যাপারে হাইকোর্টের নির্দেশ মিলবে।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ের নেতাইয়ে সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাটের বাড়ির সশস্ত্র শিবির থেকে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। গুলি চালানোর সেই ঘটনায় চার মহিলা-সহ ন’জন গ্রামবাসী নিহত হন। আহত হন ২৮ জন। ঘটনাটি নিয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে তোলপাড় চলে। প্রথমে সিআইডি সেই ঘটনার তদন্ত করলেও পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে তদন্তভার নেয় সিবিআই। ২০১১ সালের এপ্রিলে ২০ জনের নামে মেদিনীপুর আদালতে চার্জশিটও পেশ করে তারা। তাতে অভিযুক্ত ২০ জনের মধ্যে আট জনকে ফেরার দেখানো হয়।
গত ২৯ এপ্রিল রাতে সিআইডি-র স্পেশ্যাল সুপার (এসএস) ভারতী ঘোষের নেতৃত্বে এক দল গোয়েন্দা পলাতক পাঁচ অভিযুক্ত ডালিম পাণ্ডে, জয়দেব গিরি, মহম্মদ খলিলউদ্দিন, তপন দে ও রথীন দণ্ডপাটকে হায়দরাবাদ থেকে গ্রেফতার করে। এঁরা সকলেই সিপিএমের নেতা ও কর্মী। তার পরে ঝাড়খণ্ড থেকে সিপিএমের বিনপুর জোনাল কমিটির সম্পাদক অনুজ পাণ্ডে এবং চণ্ডীতলা থেকে বেলাটিকরির লোকাল কমিটির সম্পাদক চণ্ডী করণকে গ্রেফতার করে সিআইডি। সকলেই এখন জেল-হাজতে আছেন। তদন্তের স্বার্থে সিবিআই এই সাত জনের মধ্যে পাঁচ জনকে নিজেদের হেফাজতে নিতে চেয়েছে। কিন্তু ধৃতদের কাউকেই তাদের হাতে দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ। অষ্টম অভিযুক্ত ফুল্লরা মণ্ডল এখনও ফেরার।
ধৃতদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য সিবিআই মেদিনীপুর আদালতে আবেদন করেছিল। কিন্তু সেই আর্জি খারিজ হয়ে যায়। সিবিআইয়ের অভিযোগ, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ওই আবেদনের বিরোধিতা করা হয়েছিল। এমনকী ধৃতেরা সিআইডি-র হেফাজতে থাকার সময় তাঁদের জেরাও করতে দেওয়া হয়নি সিবিআই-কে। ওই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ধৃতদের কোনও রকম জেরা করতে না-পারায় তদন্ত এখনও তিমিরেই রয়েছে। নতুন কোনও তথ্য জোগাড় করতে পারেনি তারা। “সেই জন্যই ধৃতদের হেফাজতে নেওয়ার জন্য আমরা হাইকোর্টে আবেদন করেছি,” বললেন সিবিআইয়ের আইনজীবী মহম্মদ আসরাফ আলি।
সিবিআই সূত্রের খবর, নেতাই গণহত্যার তদন্তে ওই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে সাহায্য করার কথা ছিল রাজ্য পুলিশ এবং সিআইডি-র। সেই অনুসারে রাজ্য পুলিশ, সিআইডি এবং সিবিআইয়ের অফিসারদের নিয়ে একটি বিশেষ তদন্তকারী দলও গঠন করা হয়। দলটি একযোগে তদন্তের কাজ করবে বলেই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সিবিআইয়ের অভিযোগ, ২০১১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নেতাই কাণ্ডে রাজ্য পুলিশ বা সিআইডি, কেউই তাদের তদন্তে সাহায্য করছে না। এমনকী ফেরারদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রেও রাজ্য পুলিশ তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেনি।
নেতাই কাণ্ডের তদন্তে যুক্ত সিবিআই অফিসারেরা সম্প্রতি সাত অভিযুক্তকে গ্রেফতারের জন্য সিআইডি-কে কোনও রকম কৃতিত্ব দিতে রাজি নন। তাঁদের যুক্তি, পলাতকেরা গত কয়েক মাস কাদের নির্দেশে এবং কোন আশ্রয়ে ছিলেন, তার খোঁজ নিলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এক সিবিআই-কর্তা জানান, চণ্ডী করণ ও অনুজ পাণ্ডে কোথায় লুকিয়ে আছেন, রাজ্য পুলিশকে অনেক আগেই তা জানানো হয়েছিল। “কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন তখন তাঁদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ দিয়ে সাহায্য করেনি,” অভিযোগ ওই সিবিআই-কর্তার। সিবিআই জানায়, ওই সাত অভিযুক্ত যখন পলাতক ছিলেন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করাই ছিল। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন রাজ্যে কারা কোথায় তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিল, এখন সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভিন্ রাজ্যের ওই আশ্রয়দাতাদের খোঁজ পাওয়া গেলে অনেক তথ্য মিলবে বলে সিবিআইয়ের ধারণা।
সিবিআই ধৃতদের নিজেদের হেফাজতে নিতে চাইছে কেন?
সিবিআই বলছে, গুলি চালানোর সময় যে-সব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, তার বেশ কয়েকটি এখনও উদ্ধার করা যায়নি। গ্রেফতার করা যায়নি জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্যা ফুল্লরা মণ্ডলকেও। ২০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করা হলেও নেতাইয়ের ঘটনায় আরও অনেকে জড়িত বলে মনে করছে তদন্তকারী দল। তদন্তে সিবিআই জেনেছে, বহিরাগত আরও কিছু দুষ্কৃতী সে-দিন সশস্ত্র অবস্থায় সেখানে ছিল। তাদের ধরার জন্য ধৃতদের জেরা করা খুবই জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy