Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাইরের বল খেলতে গিয়েই বিপাকে পড়ছেন বারবার

ছিল যাদবপুরের উপাচার্য বনাম পড়ুয়া। হল মুখ্যমন্ত্রী বনাম ছাত্র! বিরোধী নেতৃত্ব এমন ঘটনাপ্রবাহে স্বভাবতই খুশি! আর তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই বিস্মিত, যাদবপুরের সমস্যাকে এ ভাবে কেন নিজের দিকে টেনে আনলেন মুখ্যমন্ত্রী? কেন ছাত্রদের প্রতিবাদের পাল্টা হিসেবে তিনি পথে নামাচ্ছেন নিজের গোটা দলকে? যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনকে কেন নিজেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বৃহত্তর রাজনীতির লড়াইতে?

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫৯
Share: Save:

ছিল যাদবপুরের উপাচার্য বনাম পড়ুয়া। হল মুখ্যমন্ত্রী বনাম ছাত্র!

বিরোধী নেতৃত্ব এমন ঘটনাপ্রবাহে স্বভাবতই খুশি! আর তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই বিস্মিত, যাদবপুরের সমস্যাকে এ ভাবে কেন নিজের দিকে টেনে আনলেন মুখ্যমন্ত্রী? কেন ছাত্রদের প্রতিবাদের পাল্টা হিসেবে তিনি পথে নামাচ্ছেন নিজের গোটা দলকে? যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনকে কেন নিজেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বৃহত্তর রাজনীতির লড়াইতে?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির ধারবাহিকতা ঘাঁটলে অবশ্য দেখা যাবে, এটাই তিনি! ছোট থেকে বড়-য় রূপান্তরের এমন উদাহরণ তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের জমানায় বারবার দেখা যাচ্ছে সেই পার্ক স্ট্রিট থেকে। পার্ক স্ট্রিটের পানশালা থেকে গাড়িতে তুলে এক মহিলাকে ধর্ষণের ঘটনাকে ‘সাজানো’ বলে মুখ্যমন্ত্রী আখ্যা না দিলে তার প্রতিবাদও তত বড় হতো না। কামদুনির ধর্ষণের পরে টুম্পা কয়াল-মৌসুমী কয়ালদের প্রতিবাদ দেখে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ‘মাওবাদী’ বলে দেগে না দিলে হয়তো শঙ্খ ঘোষদের পথে নামতে দেখা যেত না। সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলছে! নিজের যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র উজাড় করে সম্মুখ সমরে নেমে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী! তাঁর মন্ত্রিসভার এক সহকর্মীর কথায়, “দিদি শুরু করেন ছোট ঘটনা বলে। পনেরো দিন পরে দেখা যায়, সেটাই বড় হয়ে গিয়েছে! আর তার জন্য মাসুল দিতে হয় মন্ত্রী, নেতা থেকে আমলাদের!”

ক্রিকেটের গোড়ার কথায় আছে, সব ডেলিভারিতেই ব্যাটসম্যান কখনও ব্যাট চালাবে না। কোন বল খেলতে হবে, কোনটা ছাড়তে হবে, এই বিচার করার ক্ষমতাই এক জনকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বানায়। রাজনীতিক মমতার এখানেই গোড়ায় গলদ! মুখ্যমন্ত্রীর মতো কিছু আসনে বসলে সব ব্যাপার যে গায়ে মাখতে নেই, এই সহজ কথা তিনি ভুলে যান। সব কিছুতেই নিজে ঢুকবেন। যে কোনও নির্দিষ্ট জায়গার সমস্যার মোকাবিলায় নিজের প্রশাসনের যাবতীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে এগিয়ে যাবেন, জড়িয়ে দেবেন দলকেও। মূল সমস্যা ছেড়ে মনঃসংযোগ হারিয়ে মাথা ঘামাবেন অপ্রাসঙ্গিক নানা অনুষঙ্গে। মুহূর্তে সেই সমস্যা চারা থেকে বটবৃক্ষ হবে।

যা হচ্ছে যাদবপুরে। যাদবপুর-কাণ্ডে আজ, সোমবারই নিজের দলকে রাস্তায় নামাচ্ছেন মমতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি অভিযানের প্রতিবাদে শনিবার কলকাতায় যে জনসমুদ্র দেখা গিয়েছে, তাতেই চঞ্চল হয়ে উঠেছেন তৃণমূল নেত্রী। দলের প্রতি তাঁর কড়া নির্দেশ, পাল্টা মিছিল করে এবং লাখখানেক লোক এনে দেখিয়ে দিতে হবে, তাঁর চেয়ে বড় কেউ কোথাও নেই! নেত্রীর নির্দেশ মানতে আজ দুপুরে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরে জড়ো হয়ে ধর্মতলা ও রাজভবনের দিকে আসবে তৃণমূলের মিছিল। ছাত্র সংগঠন তো বটেই, শিক্ষক-অধ্যাপক-শিক্ষাকর্মীদেরও অনেককে সামিল করা হবে সেই মিছিলে। যে মিছিলের আগের দিন সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো তথা তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক পেজে ঘটা করে মন্তব্য করা হয়েছে ‘মদ-গাঁজা-চরস বন্ধ, তাই কি প্রতিবাদের গন্ধ’? অনুগামীরা ‘ঠিক ঠিক’ বলে সমর্থনও জানিয়েছেন! তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, শিক্ষক-ছাত্র-অধ্যক্ষদের সামনে রেখে তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’ মোড়কে আজকের মিছিলে যুবা নেতা হিসেবে থাকার কথা অভিষেকেরও। তিনি রবিবার এই নিয়ে মুখ খোলেননি।

শাসক দলের অনেক নেতাই জানেন, যাদবপুর নিয়ে পাল্টা মিছিলে নিজেদেরই বিপন্নতা প্রকট করা হয়। তবু নেত্রী বলেছেন বলে করতেই হবে! দলের এক যুব নেতা এ দিন বলেছেন, “শিক্ষায় অরাজকতার প্রতিবাদে এই মিছিল। শুধু তৃণমূল নয়। আমরা বলছি, শিক্ষায় অরাজকতার প্রতিবাদ যাঁরা করছেন, তাঁরা সকলেই এই মিছিলে আসুন।” অথচ সরকার চালানোর স্বাভাবিক নিয়ম মানলে এমন মিছিল করারই কথা নয় শাসক দলের! যা ছিল একান্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা, সেখানে পুলিশ কমিশনারকে নামিয়ে, স্বরাষ্ট্রসচিবকে দিয়ে রাজ্যপালের কাছে মাওবাদী তত্ত্ব হাজির করিয়ে, তার পরে মদ-গাঁজার তত্ত্ব আবিষ্কার করে এবং সর্বোপরি এমন মিছিলের আয়োজন করে তাকে বৃহত্তর সামাজিক প্রতিবাদে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীই।

এটাই অবশ্য মমতা এবং তাঁর তৃণমূলের দস্তুর। সীতারাম ইয়েচুরি সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য হওয়ার পরে তাঁর প্রতি দলের এক প্রবীণ পলিটব্যুরো সদস্যের উপদেশ ছিল, এখন থেকে মাথা ঠান্ডা করে চলতে হবে। বুঝতে হবে, পলিটব্যুরো সদস্য হিসেবে কোন বিষয়ে মাথা গলানো উচিত, কোনটা উচিত নয়। মমতার দলে এমন পরামর্শ দেওয়ার লোক নেই। স্বয়ং মমতারও পরামর্শ শোনা ধাতে নেই! যার পরিণতি অতীতের বেশ কিছু ঘটনার মতো এ বার যাদবপুর-কাণ্ডেও দেখছেন রাজ্যবাসী।

দেখছেন তৃণমূলের নেতারাও। মমতা জমানার গোড়ার দিকে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড থেকে হালফিল যাদবপুর পর্যন্ত সেই একই উপসর্গ। দলের নেতাদেরও কেউ কেউ উপলব্ধি করছেন, কোথায় গলদ। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে কিছু বলবেন না! কারণ তাঁরা জানেন, নেত্রী প্রশ্নহীন আনুগত্য পছন্দ করেন। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে দল বা প্রশাসনের অন্যান্য পারিষদ, মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের সকলে এই প্রশ্নহীন আনুগত্যের শর্তই পালন করে চলেছেন নিপুণ ভাবে! সেই শর্ত মেনেই তাঁরা সকলে এখন মিছিল আয়োজনে ব্যস্ত।

যাদবপুর-কাণ্ডকে কেন নিজের সঙ্গে ছাত্রদের লড়াইয়ে পরিণত করে তুললেন মুখ্যমন্ত্রী? বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ বলছেন, বিরুদ্ধ মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা থেকেই তৃণমূল নেত্রীর এমন আচরণ। তিনি সব পারেন এবং সবেতেই তিনি শ্রেষ্ঠ, সে কবিতা লেখা, ছবি আঁকা বা সরকার চালানো এমন এক ভাবনায় মমতা বরাবরই জারিত। তাঁর কোনও কাজ নিয়ে কারও সামান্যতম সংশয় থাকলে তিনি ছেড়ে কথা বলতে নারাজ! কেউ কেউ বলেন, এ আসলে ‘স্বৈরাচারী’ মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। যে মানসিকতা কাউকে কোথাও কোনও পরিসর দিতে চায় না। যে কোনও অঙ্কুরেই এই স্বৈরাচারী মনোবৃত্তি বিদ্রোহের মহীরূহ দেখে এবং পিষে ফেলতে আগ্রাসী হয়।

তাঁর নিজের দল এবং বিরোধী, দুই শিবিরেরই বহু নেতা মনে করেন, তৃণমূল নেত্রীর শ্রেষ্ঠ সম্পদই আসলে এখন তাঁর বৃহত্তম দুর্বলতা! এমনই এক জনের কথায়, “যে জেদ মমতাকে তুলে এনেছে, সেই জেদই এখন ওঁকে টেনে নামাচ্ছে!”

বিরোধী নেত্রী হিসেবে এই জেদ এবং সাহসই কিন্তু মমতাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিল জনমানসে। বাম জমানায় বহু ক্ষেত্রে অন্য কেউ যখন রুখে দাঁড়ানোর সাহস পাননি, মমতা তখন সেখানে ছুটে গিয়েছেন। আপদে-বিপদে অন্য সব তুচ্ছ করে এই দৌড়ে যাওয়ার জেদ মমতাকে ভোটবাক্সে ফল দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই জেদই আবার তাঁর কাল হয়েছে! কোথায় মাথা গলাতে নেই, সেই কাণ্ডজ্ঞানই তিনি প্রায় ভুলতে বসেছেন জেদের বশে। কলকাতায় তৃণমূলের এক কাউন্সিলর যেমন বলছেন, “কী দরকার ছিল যাদবপুর নিয়ে পাল্টা মিছিলের!

এতে তো আরও বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ছাত্রদের প্রতিবাদে আমরা ভীষণ বিচলিত!”

মমতা অবশ্য নিজের জেদে অবিচল। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিক্ষা নেবেন না, কারও সুপরামর্শেরও ধার ধারবেন না! বরং, নিজেরই বলা কথা থেকে সরে আসবেন স্বৈরাচার আর জেদের তাড়নায়। শিক্ষা ক্ষেত্রের কথাই ধরা যাক। রাজনীতির স্পর্শ থেকে শিক্ষাকে দূরে রাখার কথা বলে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। নতুন সরকার আসার পরে সেই লক্ষ্যে আইন পর্যন্ত সংশোধন করার তোড়জোড় হল।

পরে মমতাই আবার পার্থবাবুর মতো সহচরদের কথায় ভেবে বসলেন যে, রাজনীতির লোকজন একেবারে না থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকবে না! অতঃপর চাকা উল্টো ঘুরলো! বাম জমানার ‘অনিলায়ন’ আরও বহু গুণ প্রকট ও স্থূল চেহারায় ফিরে এল ‘মমতায়ন’ হয়ে! যার পরিণাম প্রতিনিয়ত দেখছে একের পর এক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হয়তো যাদবপুর।

আপাতত নেত্রীর জেদ এবং ‘আমিই শ্রেষ্ঠ’-র মান রাখতে নাকাল হচ্ছেন তাঁরই দলের সৈনিকেরা! ছুটির দিনে দলনেত্রীর বাড়িতে নানা শাখা সংগঠনের নেতা-নেত্রীদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে, কী করে পাল্টা মিছিল সফল করা যায়। কী করে রাজ্যপালকে বোঝানো যায়, তৃণমূলের দম কিছু কম নয়! চেষ্টা চলছে, যত বেশি সম্ভব কমবয়সী মুখ আজকের মিছিলে হাজির করে প্রমাণ করে দেওয়ার যে, তরুণ প্রজন্ম তৃণমূল নেত্রীর পক্ষেই আছে।

তৃণমূলেরই এক নেতার কথায়, “শনিবারের মিছিলে আমাদেরও অনেক ভোটার ছিল। এখন পাল্টা মিছিলে কত তরুণ ছেলেমেয়ে জোগাড় করব? কী বলেই বা আনব তাদের?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE