Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বাংলার রোগ ধরতে পারিনি: রাকেশ

রোগটা তিনি ধরতে পারছেন না, তাই ওষুধও কাজ করছে না। রাজ্যে তৃতীয় দফা ভোটের পর থেকে এই অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা। ভোটপর্ব সাঙ্গ হওয়ার পরে হুবহু সেই কথাটাই নিজের মুখে স্বীকার করে নিলেন সুধীরকুমার রাকেশ। মঙ্গলবার বললেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বিহার-উত্তরপ্রদেশের অভিজ্ঞতাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। রাজ্যে প্রথম দফার নির্বাচনের ঠিক আগের দিন, ১৬ এপ্রিল বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে কলকাতায় এসেছিলেন রাকেশ।

কাজী গোলাম গউস সিদ্দিকী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

রোগটা তিনি ধরতে পারছেন না, তাই ওষুধও কাজ করছে না। রাজ্যে তৃতীয় দফা ভোটের পর থেকে এই অভিযোগ তুলেছিলেন বিরোধীরা। ভোটপর্ব সাঙ্গ হওয়ার পরে হুবহু সেই কথাটাই নিজের মুখে স্বীকার করে নিলেন সুধীরকুমার রাকেশ। মঙ্গলবার বললেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বিহার-উত্তরপ্রদেশের অভিজ্ঞতাকেও ছাপিয়ে গিয়েছে।

রাজ্যে প্রথম দফার নির্বাচনের ঠিক আগের দিন, ১৬ এপ্রিল বিশেষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে কলকাতায় এসেছিলেন রাকেশ। শহরে পা রেখেই দাবি করেছিলেন, অবাধ নির্বাচন কী ভাবে করাতে হয় তা তিনি জানেন। যারা এই কাজে বাধা দেবে তাদের সামলানোর ওষুধও তাঁর জানা আছে।

প্রথম দু’দফা মোটের উপর শান্তিতে কাটলেও তৃতীয় দফা থেকেই কিন্তু ভোটে ব্যাপক কারচুপি এবং রাজনৈতিক সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু রাকেশ এ নিয়ে তেমন কোনও হেলদোল না দেখিয়ে দাবি করেন, ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ শুনে তখন দিল্লি থেকে নির্বাচন কমিশন এ রাজ্যে আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু সব সত্ত্বেও চতুর্থ দফা এবং পঞ্চম দফায় অশান্তি এড়ানো তো যায়ইনি। বরং সোমবার শেষ দফার ভোটে এ বার সব চেয়ে বেশি রক্তপাত হয়েছে। সোমবারই রাকেশ প্রথম বার বেদী ভবনে তাঁর অস্থায়ী আবাস থেকে বেরিয়ে উপদ্রুত এলাকায় ছুটে যেতে বাধ্য হন। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় ব্রাহ্মণচকে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলার পরেই রাকেশ এ রাজ্যের প্রকৃত ভোটচিত্রটি বুঝতে পেরেছেন বলে ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন। মেনে নিয়েছেন, বিহার-উত্তরপ্রদেশে ভোট করানোর অভিজ্ঞতা দিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ মডেল’ সামলাতে কার্যত ব্যর্থই হয়েছেন তিনি।

সোমবার সন্ধ্যায় হাড়োয়া থেকে কলকাতায় ফেরার পথে রাকেশ বলেন, “আমার যে ওষুধ ছিল, তা বিহার-উত্তরপ্রদেশের জন্য অব্যর্থ দাওয়াই। কিন্তু এখানে রোগটা ধরতে পারিনি। তাই ওষুধ খাটল না।”

বিহার-উত্তরপ্রদেশের অভিজ্ঞতা থেকে রাকেশ-সহ ভিন্ রাজ্যের পর্যবেক্ষকদের বেশির ভাগেরই ধারণা ছিল, বুথগুলিকে ঠিকঠাক নিরাপত্তা দিতে পারলে ভোটাররা অবাধে ভোট দিতে পারবেন। তাই পর্যবেক্ষক এবং জেলাশাসকদের সঙ্গে বৈঠকে বারবার বুথের মধ্যেই যাবতীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা। রাকেশ এখন স্বীকার করছেন, “পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রকৃত চরিত্র আমরা আঁচই করতে পারিনি। আমার মতো ভিন্ রাজ্য থেকে যে সব পর্যবেক্ষক এসেছিলেন, ভোট-সন্ত্রাস বলতে তাঁদের মাথায় গাঁথা ছিল বিহার-উত্তরপ্রদেশের ছবি। যেখানে বাহুবলীরা বুথ দখল করে নেন। কিন্তু এখানে যা ঘটল তা বিহার-উত্তরপ্রদেশকেও হার মানায়।”

কিন্তু ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময়েও তো রাকেশ পুলিশ পর্যবেক্ষক হয়ে এ রাজ্যে এসেছিলেন। তখন তিনি রাজ্যের ভোট কেমন হয়, তা বুঝতে পারেননি? রাকেশের ঘনিষ্ঠ সূত্রে বলা হয়, সে বার রাজ্যে যে পরিবর্তন হতে চলেছে, তা মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল। ফলে সে বারের আবহও অন্য রকম ছিল। ‘পশ্চিমবঙ্গ মডেল’ সে ভোটে সক্রিয় ছিল না।

কী এই ‘পশ্চিমবঙ্গ মডেল’?

রাকেশ তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, এ রাজ্যে ভোটের দিন বুথ দখলের প্রয়োজনই কার্যত পড়ে না। কারণ, ভোটের অন্তত দিন সাতেক আগেই ভোটের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। ভোটের দিন তৎপর হয়ে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ পর্যবেক্ষকের অভিজ্ঞতা বলছে, এ রাজ্যে গ্রামশুদ্ধ মানুষকে আগে থেকেই ভয় দেখিয়ে রাখা হয়। বিরোধী কোনও দলকে ভোট দিতে পারেন, এমন সম্ভাবনার ভোটারদের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়। অনেক সময় তাঁদের বুথের অনেক দূরেই আটকে দেওয়া হয়। রাকেশের মতে, এরই নাম ‘পশ্চিমবঙ্গ মডেল’। এই নতুন মডেলের অভিজ্ঞতাই এ বার প্রাপ্তি বিহার ক্যাডারের এই আইএএস অফিসারের।

ঘটনা হল পশ্চিমবঙ্গের ভোট যে অনেকটা আলাদা রকমের, সে কথা তৃতীয় দফার ভোটের দিনই (৩০ এপ্রিল) রাকেশকে বলার চেষ্টা করেছিলেন বিরোধীরা, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। একাধিক জেলা থেকে অশান্তির খবর যখন আসছে, তখনও বেদী ভবনেই নিজের ঘরে বসেছিলেন রাকেশ। ভোট অবাধ হয়নি, এ অভিযোগ মানতেই চাননি তিনি। বারবারই বলেছেন, বুথের ভিতরকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কমিশনের দায়িত্ব এবং কমিশন তা পালন করেছে। ভোট শান্তিপূর্ণ যদি না-ও হয়ে থাকে, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে তৃতীয় দফার পরে এমনটাই দাবি করেছিলেন রাকেশ। কিন্তু সোমবার সন্ধেয় পঞ্চম ও শেষ দফার পরে তাঁর মত অনেকটাই বদলে গিয়েছে। হাড়োয়ার অভিজ্ঞতাই এ ব্যাপারে অনেকটা ভূমিকা নিয়েছে বলে মানছেন রাকেশ।

ভয় মানুষকে কী ভাবে প্রভাবিত করে, হাড়োয়ার মানুষের সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছেন রাকেশ। সোমবার বিরাট বাহিনী নিয়ে গ্রামে গিয়েও তিনি তাঁদের অভয় দিতে পারেননি। ভোট দেওয়ার জন্য বুথেও নিয়ে যেতে পারেননি। শাসক দলকে ভোট না দিলে যে গ্রামছাড়া হতে হবে, ভোট পরবর্তী পর্যায়ে চরম হেনস্থার শিকার হতে হবে এমন ভয় থেকেই গ্রামবাসীরা আর বুথ-মুখো হননি। রাকেশকে তাঁরা সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, “আজ নিরাপত্তা দেবেন, কাল কী হবে?”

কমিশন সূত্রে খবর, গত ক’দিন ধরে বেশ কিছু জায়গা থেকেই বিভিন্ন সূত্রে এই ধরনের খবর পাচ্ছিলেন রাকেশ। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে পারেননি বলে সে সবকে তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই রাজনৈতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসার (সিইও)-র দফতরের অফিসারেরা কেন রাকেশকে সতর্ক করেননি? রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের দফতর সূত্রে এ দিন এর উত্তরে বলা হয়, রাকেশ অনেক বড় মাপের অফিসার। তাঁর পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে সিইও কোনও মতামত দিতে পারেন না।

রাকেশ এখন কী ভাবছেন? তাঁর বক্তব্য, “কমিশনের ব্যর্থতা বলব না, তবে এটা মানছি, কিছু মানুষের ব্যর্থতা রয়েছে। বিশেষত স্পর্শকাতর বুথ চিহ্নিত করা এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারির এলাকা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে।” এই সব ব্যাপারে প্রশাসন যে শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়, সেটা ঠেকে শিখেছেন বলে রাকেশের দাবি। বুথের নিরাপত্তার চেয়েও ভোটের সাত-দশ দিন আগে থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারি যে অনেক জরুরি, সেটাও তিনি বুঝেছেন। এখন তাঁর মনে হচ্ছে, আগে থেকে গ্রামের মানুষের আস্থা ফেরানোর কাজ করা দরকার ছিল।

কিন্তু এই উপলব্ধিতে পৌঁছতেই এক মাসের বেশি সময় লেগে গিয়েছে। ভোটপর্বও চুকে গিয়েছে। তবু শেষ বেলায় ‘ওষুধ খাটল না’ বলে স্বীকারোক্তি করে রাকেশ পরোক্ষে ভোটপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। সিপিএম নেতা শ্যামল চক্রবর্তীর মন্তব্য, “রাকেশের বক্তব্যে এই ভোটের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেল। বিরোধীরা যে অভিযোগ করছিলেন, উনি তাকেই মান্যতা দিলেন।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অবশ্য কটাক্ষ, এই বোধোদয় রাকেশের অনেক দেরিতে হল। তাঁর অভিযোগ, “মিস্টার রাকেশ এত দিন প্রার্থীদের কথাকেই গুরুত্ব দেননি।”

আর শাসক তৃণমূল? দলের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “এ সব কথা উনি (রাকেশ) বলেননি। গল্প তৈরি করছে আনন্দবাজার।”

রাকেশ নিজে এ দিন বিকেলে পটনা গিয়েছেন। সেখান থেকে কাল, বৃহস্পতিবার ভোট গণনার আগের দিন কলকাতায় ফিরবেন। গণনাপর্ব শেষ করে ১৭ এপ্রিল তিনি ফের পটনা যাবেন। পরে ভোটের রিপোর্ট পাঠিয়ে দেবেন দিল্লিতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE