Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মরিয়া লড়াইয়ের সাক্ষী প্রচারের শেষ প্রহর

রাজাবাজার লাগোয়া রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে লাল শালুর মঞ্চ থেকে উর্দু মেশা হিন্দিতে বক্তৃতা ভেসে আসছিল। ঠিক তখনই কয়েক হাত দূরে সাহেববাগানের মোড় পেরিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছে জোড়া ফুলের ব্যানারে ঢাকা ‘ছোট হাতি’ (মিনিডর)। লাল শালু চোখে পড়তেই হাতি থমকে দাঁড়াল।

প্রচারের শেষ দিনে দুই প্রার্থী সুব্রত বক্সী ও সুগত বসুকে নিয়ে রোড শোয়ে তৃণমূল নেত্রী। হাজির সাংসদ মিঠুনও। সুকান্ত সেতু থেকে খিদিরপুরের দিকে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

প্রচারের শেষ দিনে দুই প্রার্থী সুব্রত বক্সী ও সুগত বসুকে নিয়ে রোড শোয়ে তৃণমূল নেত্রী। হাজির সাংসদ মিঠুনও। সুকান্ত সেতু থেকে খিদিরপুরের দিকে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০২:৪০
Share: Save:

রাজাবাজার লাগোয়া রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে লাল শালুর মঞ্চ থেকে উর্দু মেশা হিন্দিতে বক্তৃতা ভেসে আসছিল। ঠিক তখনই কয়েক হাত দূরে সাহেববাগানের মোড় পেরিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছে জোড়া ফুলের ব্যানারে ঢাকা ‘ছোট হাতি’ (মিনিডর)। লাল শালু চোখে পড়তেই হাতি থমকে দাঁড়াল।

শাসক দলের প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে প্রচাররত দলীয় কাউন্সিলর ফরজানা আলম ঝাঁঝিয়ে উঠছেন, গাড়ি পিছোতে বলে। বলছেন, “এখানে কে জিতবে, সুদীপদা না অন্য কেউ! তা এখনই ফয়সালা করে দিচ্ছি!” শুনে বাম প্রার্থী রূপা বাগচীর সমর্থনে সভার বক্তৃতা কয়েক মুহূর্ত থমকে গেল। ফরজানা মাইক হাতে সুদীপ-মমতার প্রশস্তি শুরু করলেন। লোকাল কমিটির নেতা, স্কুলশিক্ষক ওয়াসিম আহমেদও একটু থেমে ফের সুর চড়ালেন। শনিবার, ভরদুপুরে পাড়ার গুটিকয়েক বাচ্চা ও জনা পঁচিশ জোয়ানের ভিড়টা কোনও দিকে না-তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বক্তৃতা শুনছে। তৃণমূলের প্রচার-গাড়ির সওয়ারিরা সে-দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে সরে গেলেন।

দমদমে বিমানবন্দর এলাকার ইটালগাছায় এর ঘণ্টা দুয়েক আগেই মুখোমুখি তৃণমূল ও বিজেপি। তৃণমূলের বিশাল পদযাত্রার সামনে পড়ে গেল গাড়িতে বিজেপি-র রোড-শো। মোদীর মুখোশধারীদের লক্ষ্য করে সঙ্গে-সঙ্গে অঙ্গভঙ্গি করে ভেসে এল সরস বাক্যবাণ। মোদীভক্তরাও কম যান না! মুখোশ অল্প তুলে প্রতিপক্ষকে সামান্য জিভ ভেঙিয়ে সাঁ করে গাড়ি বেরিয়ে গেল।

শনিবার, লোকসভা ভোটের শেষ পর্যায়ের আগে শেষ দিনের প্রচারে কেউ কাউকে এক ছটাক জমি না-ছাড়ার মানসিকতাই স্পষ্ট। সাধারণত, যে-সব জায়গা ভোটরঙ্গের আবহ থেকে কিছুটা দূরে পড়ে থাকে সেখানেও ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করেছে সাত-সকালেই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মূল ফটকে জনে-জনে ‘মোদী টুপি’ পরাতে ব্যস্ত ‘মোদীসেনা’রা। দলটির মুখপাত্র সঞ্জীব নারুলা বলছিলেন, “এই তো অমৃতসরে অরুণ জেটলি, অমেঠীতে স্মৃতি ইরানির প্রচার সেরে আসছি! এ বার কলকাতা। কলকাতায় আমরা আস্তে আস্তে বাড়ছি।” ভিক্টোরিয়া-চত্বরে অবশ্য বেশিরভাগই ভিন রাজ্যের পর্যটক। এর মধ্যেই সেক্টর ফাইভের কর্মী শুভ্রজ্যোতি সাহা বান্ধবীকে নিয়ে মাঠে ঢোকার সময়ে সাগ্রহে টুপি হাতে নিয়ে ঢুকে গেলেন।

আমজনতার কাছে পৌঁছতে সব দল বা প্রার্থীই নিজের মতো স্ট্র্যাটেজি সাজিয়েছে। তমলুকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বড় মাপের রোড-শো এবং সাইকেল-র্যালিতে মেতে থেকেছেন তৃণমূল নেতা শুভেন্দু অধিকারী। সকালে মেচেদা থেকে কাকতিয়া অবধি শুভেন্দুর পরিক্রমার সময়েই মেচেদার আনন্দলোকের মাঠে পথসভা করছিলেন বিমান বসু। নন্দীগ্রামের শহিদ-বেদীর সামনে শুরু করেছিলেন, সেখানেই এ দিন প্রচার শেষ করেন শুভেন্দু।

দুপুরের দিকে দক্ষিণ কলকাতায় নামল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রোড-শো। কলকাতা (দক্ষিণ)-এর প্রার্থী সুব্রত বক্সী ও যাদবপুরের সুগত বসুকে হুডখোলা গাড়িতে সঙ্গে নিয়ে আড়াই ঘণ্টা ধরে মিছিল চলল সুলেখা মোড়ের সুকান্ত সেতু থেকে খিদিরপুর। তার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ, মিঠুন চক্রবর্তী। আলিপুরে তৃণমূল সমর্থকেরা সাদা পায়রা উড়িয়ে মিছিলকে স্বাগত জানালেন। তবে মিছিলে তুলনামূলক ভাবে লোক কম হয়েছে বলেই ধারণা অনেকের।

শেষ দিনে ভোট-কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘কভার’ করতেই ব্যস্ত থেকেছেন বেশিরভাগ প্রার্থী। বহরমপুরে কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরী সকালে শক্তিপুর, বিকেলে কান্দির জেমোয় ঘুরেছেন। কলকাতা (উত্তর)-এর বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিংহও বিডন স্ট্রিট থেকে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত রোড-শো করলেন বিকেলে। কংগ্রেসের সোমেন মিত্রও বেলেঘাটা অঞ্চলের আতিপাতি ঘুরেছেন।

একে শেষ দিন, তায় সন্ধ্যায় ছ’টার মধ্যে প্রচার সারতে হবে, তাই দিনের নির্ঘণ্ট অন্য ভাবে ছকতে বাধ্য হয়েছেন প্রার্থীরা। যেমন, ঘাটালের প্রার্থী টলিউড-তারকা দেবও দুপুরের বিরতি বাদ দিয়ে কেশপুর ও খড়্গপুরে ৭-৮টি জনসভা করেন। দুপুরের টিফিনও গাড়িতে সেরেছেন। দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস প্রার্থী মালা রায় বলছিলেন, “সন্ধ্যায় সভা করা যাবে না, কিন্তু গার্ডেনরিচে সভা করাটা খুব জরুরি ছিল। ওখানে ভোট লুঠ হতে পারে!” দুপুরেই সেখানে সভা করেন মালা।

শেষ মুহূর্তের ফাঁকফোকর ভরাট করার লক্ষ্যেই এ দিন বিকেলে বারাসতের বিজেপি প্রার্থী পিসি সরকার (জুনিয়র)-এর গন্তব্যও দেগঙ্গা। বললেন, “সংখ্যালঘুদের নানা রকম ভুল বোঝানো হচ্ছে। আমি গেলাম, জমিয়ে চা খেয়ে এলাম।”

তবে শেষ দিনের প্রচারটা বেশ কষ্টকর ছিল কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী তাপস সিংহের পক্ষে। তাঁকে নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে। বাম প্রার্থী ব্যথায় ডান হাত তুলতে পারছেন না। গাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে কোনওমতে বাঁ হাত নেড়ে মাইক হাতে দু’চার কথা বলছিলেন। চণ্ডীপুর, কলাবেড়িয়ায় জনসভা শেষ করেই তাঁকে তমলুক যেতে হল, মাথার চোটের জন্য সিটি স্ক্যান করাতে।

শেষ দিনে প্রচারের পাশাপাশি ভোট-সংক্রান্ত জরুরি মিটিংও সারতে হচ্ছে। শুভেন্দু অধিকারী যেমন ফোনে ফোনে কেন্দ্র থেকে দূরে কর্মরত ভোটারদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা সম্পর্কে ফাঁকে ফাঁকে খোঁজ নিচ্ছিলেন। পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট হচ্ছে, তাই কর্মচারীরা নেই বলে কলকাতার ভবানী দত্ত লেনের পাইস হোটেল এ দিন বন্ধ।

সিপিএমের নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ও ঢাকুরিয়া বা যদুবাবুর বাজার পরিক্রমার পাশাপাশি দরজা বন্ধ করে জরুরি সাংগঠনিক সভা সেরেছেন। পিসি সরকারের স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় এ সব কাজ হল, প্রচারের পরের প্র-পাঁচ, প্র-ছয় বা প্র-সাত। হেসে বললেন, “এতেই তো প্রসাদ পাব!”

আপাতত অবশ্য এ দিন সন্ধ্যা ছ’টা বাজতে না-বাজতেই দলীয় প্রতীক আঁকা টুপি, ছাতা, অটোর গায়ের ব্যানার খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ডান-বাম শিবিরের নেতারা। প্রচারের ঢাকঢোল থামতে আম-নাগরিকেরা কেউ কেউ একটু স্বস্তিও পেয়েছেন। সন্তোষপুরে জনসভার লাউডস্পিকার খোলা হতেই স্থানীয় বাসিন্দা এক মহিলার মন্তব্য, “আঃ শান্তি! ঝালাপালাটা এ বার বন্ধ হল!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE