Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

সব চিকেন ভোটকে লিয়ে চলা গয়া

কাজ আর অকাজের ভিড় থেকে কোনও রকমে দিন সাতেক বার করে নিয়ে পৌঁছেছি কালুক। সিকিমের এক প্রান্তিক গঞ্জ। আমি আর দূর্বা তো আছিই, সঙ্গে শ্রীকান্তদা, অর্ণাদি, দিঠি আর মহুল। আড্ডা জমে যাবে, সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে কপাল ভাল থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেতে পারে। যে রিসর্টে উঠেছি, তার টানা বারান্দা থেকে সামনে তাকালেই বেশ বড়সড় চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বিখ্যাত এই রেঞ্জকে, যদিও আপাতত বহু কুয়াশার চাদর পেরিয়ে দৃষ্টি সেখানে যেতে পারছে না। এখানে দিন তিনেক কাটিয়ে উঠে যাওয়ার কথা দার্জিলিঙে। সেখানে আবার চার দিনের ছুটি কাটানো।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ০৩:৫৫
Share: Save:

কাজ আর অকাজের ভিড় থেকে কোনও রকমে দিন সাতেক বার করে নিয়ে পৌঁছেছি কালুক। সিকিমের এক প্রান্তিক গঞ্জ। আমি আর দূর্বা তো আছিই, সঙ্গে শ্রীকান্তদা, অর্ণাদি, দিঠি আর মহুল। আড্ডা জমে যাবে, সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে কপাল ভাল থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেতে পারে। যে রিসর্টে উঠেছি, তার টানা বারান্দা থেকে সামনে তাকালেই বেশ বড়সড় চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বিখ্যাত এই রেঞ্জকে, যদিও আপাতত বহু কুয়াশার চাদর পেরিয়ে দৃষ্টি সেখানে যেতে পারছে না। এখানে দিন তিনেক কাটিয়ে উঠে যাওয়ার কথা দার্জিলিঙে। সেখানে আবার চার দিনের ছুটি কাটানো।

সন্ধে নাগাদ পৌঁছতেই হাসিমুখে ছুটে এল এক ভুটিয়া যুবক। রাতের খাবারের অর্ডার নিতে। কলকাতার গরমে ডাল আলুসেদ্ধ খেয়ে খেয়ে বিরক্ত হয়ে যাওয়া আমরা সকলেই চেঁচিয়ে উঠলাম ‘চিকেন’ বলে (প্রথম দিনই মাটনের সাহস পাইনি, আর পাহাড়ে গিয়েও মাছ খাওয়ার কোনও মানেই হয় না)। কিন্তু সন্ধের আলোর মতোই নিভে গেল সেই যুবকের মুখ। কাঁচুমাচু হয়ে সে বলল, “চিকেন তো নহি মিলেগা স্যর।” কথাটা শুনে একটু অবাকই হলাম। কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, “দো দিন পহেলে ইঁয়হা ভোট থা। সব চিকেন ভোট কে লিয়ে চলা গয়া।”

কথাটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, সন্দেহ নেই। কিন্তু মানেটা কী? জানা গেল, ভোটের খাতিরে মান্যিগণ্যি সব নেতা-প্রার্থী-কর্তারা এসে এখানে থেকে গিয়েছেন ক’দিন, তাই যাবতীয় চিকেন তাঁদের উদরস্থ হয়েছে। এখন শহর থেকে মুরগির মাংস নিয়ে এসে তবেই রান্না। বাচ্চাদের মনটা একটু মুষড়েই গেল। চিকেন নেই, কাঞ্চনজঙ্ঘাও নেই।

ভোট চলছে। এক দফা, দু’দফা, দফায় দফায়। চলছে এই ভারতবর্ষে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলতে মানুষ যে দেশকে বোঝে। কিন্তু ভারতবর্ষ বলতে ঠিক কোন দেশটাকে বুঝি আমরা? আমরা মানেই বা কারা? এক শব্দের ‘আমরা’ দিয়ে ১২৫ কোটিকে বন্ধনীভুক্ত করা যায় কি? বরং কত শত স্তর আর বন্ধনীতে এই ‘আমরা’ বিভক্ত, তা বোধ করি আজও স্পষ্ট নয়। কিন্তু আমি যদি এই আমাকেই, আমার মতো কাউকেই ধরে নিই এই ঘরেও নহে পারেও নহে যে জন আছে মাঝখানে, সেই আমির ভারতবর্ষ তা হলে ঠিক কোনটা? একটা ভারতবর্ষকে ইতিহাস বইয়ে পড়ে এসেছি, সেইটা? একটা ভারতবর্ষকে টেলিভিশনে দেখছি রোজ, সেইটা? নাকি দেখা আর পড়ার বাইরে যে আদিগন্ত জন্মভূমি পড়ে আছে, সেইটা? আমি কোন দেশের বাসিন্দা? খুব ক্লিশে এই কথাগুলো। কিন্তু সে ভাবে দেখতে গেলে সূর্যোদয় পৃথিবীর ক্লিশেতম বিষয়, তবু লোকে আজও তাকে নিয়ে কাব্যি করে। সুতরাং এই প্রশ্নটা অতি ব্যবহৃত হলেও, ফেলনা বলা যাচ্ছে না।

যত বয়স বাড়ছে আমার, ততই মনে হচ্ছে এই দেশটাকে আমি চিনতে পারছি না। আমার চার দশকের তৈরি করা ভারতবর্ষের ধারণার সঙ্গে মেলাতে পারছি না। যাঁরা তথাকথিত রাজনৈতিক ক্ষমতায় আছেন বা উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের ছদ্মবেশ নিয়ে আসলে ক্ষমতাই দখল করতে চাইছেন, তাঁদের কথা বলছি না।

কারণ ঈশ্বর বা ভূতের মতো তাঁদের প্রতিও আমার ন্যূনতম আগ্রহ নেই। কিন্তু নিজেকে নিয়ে, নিজেদের নিয়ে আগ্রহ তো যেতে চায় না। যে জাতি এত হাজার বছর ধরে অসহায়তার বোঝা টেনে চলেছে, বিরক্তির পাশাপাশি তার জন্য কষ্টও তো থাকেই। কারণ আমিও তার বাইরে নই।

আমার নিজের মধ্যেও আছে এই অসহায়তার বীজ, আমার শিরাতেও বইছে সমর্পণের রক্ত।

এই সব ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতেই কালুকের দিনগুলো ফুরলো। এলাম দার্জিলিঙে। বাঙালির ক্লিশেতম টুরিস্ট স্পট। ভোট হয়ে গিয়েছে, একটা বেশ দমচাপা আবহাওয়া। ছুটি থাকা সত্ত্বেও রেজাল্টের কয়েক দিন আগে পরীক্ষার্থীদের মুখ যে রকম হয়। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বললাম, উড়ো মন্তব্য ছাড়া কিছুই জুটল না। হয়তো বাইরের মানুষ বলেই স্থানীয়রা ভোট বিষয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। দু’-এক জন যে ক্ষোভের কথা, আশার কথা বললেন, তা পাহাড়ে কিছু নতুন নয়। যে ফলের কথা বললেন, তা-ও পাহাড় আগেই দেখিয়েছে। তা হলে নতুন কী? এই প্রবল নিরাসক্তিও তো পুরনো হয়ে এল। তবে?

এক বিকেলে একা হাঁটতে হাঁটতে ম্যালের ভিড় ছাড়িয়ে কিছু দূর এগিয়ে দেখি, খাদের কিনারায় একটা কায়দার চেয়ার পাতা আছে। সামনে রেলিং। এক ঝলক দেখেই খুব চেনা মনে হল। তার পর বুঝলাম, এইখানে বসেই সম্ভবত ক্লান্ত করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় গেয়ে উঠেছিলেন, ‘এ পরবাসে রবে কে হায়...।’ পাহাড়ের গায়ে সন্ধে হয়ে আসছিল তখন... হঠাৎ মনে হল, ওঁর গলায় বসানো এই গানটা কি যুগ যুগ ধরে বয়ে আসা আম ভারতবাসীর গান? যারা চিরকাল নিজভূমে পরবাসী হয়ে কাটিয়ে গেল, আজও যাচ্ছে? এই যে আমি, আমার কাছেও আজ দেশের কোনও স্পষ্ট ছবি তৈরি হয়নি যখন, সেই আমিও কি তা হলে পরবাসেই দিন গুজরান করছি না? এর বেশি প্রশ্ন করতেও ভয় হল, কারণ আমার সামনেও তখন সন্ধে হয়ে আসছে। যদিও পাহাড়ের কুয়াশা একটুও সরেনি।

যখন লিখতে শুরু করেছিলাম ‘অ-নির্বাচনীয়’, ভেবেছিলাম খুব বুঝি বুঝে ফেলব, এই যাকে বলে ‘পাল্স’। কিন্তু দু’টো গঞ্জ, চারটে গ্রাম আর একটা পাহাড়ি টুরিস্ট স্পটে ঘুরে বেড়িয়ে অন্ধের হস্তীদর্শনই হয় কেবল। এত যুগের, এত মানুষের একটা দেশের নাড়ি অনুভব করা যায় না। যেটুকু ঘুরেছি, কথা বলেছি, কৌতূহল আর ধন্দ, দুই-ই বেড়েছে। বুঝতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছি, খুঁজতে গিয়ে তল। কেন একটা গোটা জাতি বঞ্চিত হতে হতে রুখে না দাঁড়িয়ে নিরাসক্ত হয়ে যাচ্ছে, কেন প্রশ্ন করার ক্ষমতা কেবল শাসকের হাতেই থেকে যাচ্ছে চিরকাল, কেন সক্কলে মিলে চেঁচিয়ে উঠে বলছে না “চাই না এই গণতান্ত্রিকতা, যার অধিকার আমাদের হাতে নেই!”

...এও এক রহস্য। ঠিক যেমন রহস্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে রয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা... আর হাঁটতে বেরনোর মুখে তৃপ্ত ছবি বিশ্বাস জিজ্ঞেস করছেন পাহাড়ী সান্যালকে, “বলি, রোস্ট হয়?” তার পর হয়-না জেনে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলছেন, “তা হলে ও পাখিতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।” ভারতবর্ষের ইতিহাস আর শাসকস্রোতের মনোভাব আর কোন বাক্যে এত চমৎকার ফুটে উঠত, আমার জানা নেই। ও পাখি রোস্ট হয় বলেই দেশটা এখনও এ ভাবে চলছে। আর সব কিছু মেনে নিয়ে সার বেঁধে মাথা নিচু করে ভোট দিতে যাচ্ছে এ দেশের আম নাগরিক... আর আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে উঁকি দিয়ে সেই ভুটিয়া যুবক এক গাল হেসে বলছে, “চিকেন নহি মিলেগা স্যর, সব চিকেন ভোট কে লিয়ে চলা গয়া।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sreejata
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE