নির্বাচনী সন্ত্রাসের প্রতিবাদে কমিশনের সামনে ঝাঁটা হাতে বিরোধী দল। কিন্তু প্রতিকার হল কোথায়? ছবি: পিটিআই।
বেনজির পঞ্চায়েত নির্বাচনের নজির তৈরি হয়ে গেল বাংলায়। মনোনয়ন প্রত্যাহার এখনও শুরুই হয়নি। তার আগেই ২৭ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকের দখলে।
২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এ যাবৎ সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল রাজ্যে। ১১ শতাংশ আসন সে বার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে নিয়েছিল তদানীন্তন শাসক বামেরা। ছি-ছি রব উঠে গিয়েছিল বিরোধী শিবির থেকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরাও বলেছিলেন, গণতন্ত্র বিপন্ন।
এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব এখনও পুরোপুরি মেটেনি। মনোনয়ন জমার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছিল। শেষ হয়েছিল মনোনয়ন খতিয়ে দেখাও। কিন্তু যে দিন থেকে প্রত্যাহার শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেই দিনই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে স্থগিত হয়ে গিয়েছে নির্বাচনের যাবতীয় প্রক্রিয়া। তাতেই দেখা যাচ্ছে, অন্তত ২৭ শতাংশ আসন তৃণমূলের দখলে চলে গিয়েছে বিনা যুদ্ধে।
বিশদ হিসেবটা কী রকম? এক বার দেখে নেওয়া যাক। রাজ্যের মোট গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৬৫০টি। তার মধ্যে ১৩ হাজার ৫০০ আসনেই বিরোধীদের কোনও প্রার্থী নেই। পঞ্চায়েত সমিতি স্তরের মোট আসন সংখ্যা হল ৯ হাজার ২১৭টি। ২ হাজার ৩০০ আসনে বিরোধী শিবির অনুপস্থিত। জেলা পরিষদ আসনের মোট সংখ্যা ৮২৫। ইতিমধ্যেই ১৩০টি আসনে কোনও বিরোধী নেই।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তথা সেফোলজিস্ট বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘ছবিটা আরও সাংঘাতিক হয়ে উঠবে। এখনও তো মনোনয়ন প্রত্যাহার হওয়া বাকি। তাতেই ২৭ শতাংশ আসন শাসক দলের দখলে। প্রত্যাহার পর্ব মিটলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের পরিমাণটা ৩৫ শতাংশ হয়ে যাবে। ৪০ শতাংশ ছুঁয়ে ফেললেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।’’
আরও পড়ুন: তৃণমূলের আর্জি খারিজ, সিঙ্গল বেঞ্চেই ঝুলে রইল পঞ্চায়েতের ভবিষ্যৎ
যে সব এলাকায় বিরোধী দলগুলি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পেরেছে, তার মধ্যে অনেক জায়গাতেই মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চাপ বাড়ানো শুরু হয়েছে। সন্ত্রাসে ঘরছাড়া বিরোধী শিবিরের অনেক প্রার্থী। দাবি প্রতিটি বিরোধী দলেরই। মনোনয়ন প্রত্যাহার শুরু হওয়ার কথা ছিল যে দিন থেকে, সেই দিনই বিরোধী শিবিরের অনেক প্রার্থী চাপের কাছে নতিস্বীকার করে মনোনয়ন তুলে নেওয়ার আবেদন জমা করে দিয়েছেন। অনেক আসন আবার এমনও রয়েছে, যেখানে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন, কিন্তু তাঁরা কেউ বিরোধী দলেন নন। তৃণমূলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তৃণমূলেরই অন্য গোষ্ঠীর কেউ। এই গোঁজ প্রার্থীরাও অধিকাংশই শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়াবেন। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের পরিমাণ ৩৫-৪০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।
বিজেপি নেতা তথা প্রাক্তন বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য তীব্র কটাক্ষ করেছেন শাসক দলকে। তিনি বলেছেন, ‘‘একদলীয় একচেটিয়া একাধিপত্য কায়েম করতেই এই দুর্বার গতি তৃণমূলের। সবক’টি বিরোধী দলের উচিত সম্মিলিত ভাবে শাসক দলকে অভিনন্দন জানানো।’’ শমীকের কথায়, ‘‘এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করছে, বাংলায় গণতন্ত্র কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই পঞ্চায়েত নির্বাচন গোটা দেশকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমরা কী পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বললেন, ‘‘এর আগে আট দফা পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছে রাজ্যে। সাত দফাই বামফ্রন্টের আমলে। এক বারই একটু বেশি সংখ্যক আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বামেদের দখলে এসেছিল। সেটা ২০০৩ সালে। ১১ শতাংশ আসনে কোনও লড়াই হয়নি। পরের বার অর্থাৎ ২০০৮ সালেই সেই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলের জয়ের পরিমাণ অর্ধেকের চেয়েও কমে গিয়েছিল। আর তৃণমূল নিজেদের রাজত্বে হওয়া প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনেই বাম আমলের সর্বোচ্চ হারকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছিল (১০.৬৮%)। এ বারে অর্থাৎ তৃণমূল জমানার দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকের জয়ের হারটা কোথায় গিয়ে থামবে— ৩০ শতাংশে, না ৩৫ শতাংশে, নাকি ৪০ শতাংশে, কেউ বুঝতে পারছেন না।’’ সুজন চক্রবর্তীর প্রশ্ন— একে কি নির্বাচন বলে?
তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য অবিচলিত। তিনি বলছেন, ‘‘রাজ্যের অধিকাংশ এলাকাতেই বিরোধীদের কোনও সংগঠন নেই। সিপিএম দলটার অস্তিত্বই বিলুপ্ত হতে বসেছে। বিজেপি-ও অধিকাংশ এলাকাতেই সংগঠন গড়ে তুলতে পারেনি। সেই কারণেই প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। এর জন্য শাসক দলকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই।’’
আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত সন্ত্রাস নিয়ে অনশনে কংগ্রেস, দাবি রাষ্ট্রপতি শাসনের
ক্ষমতাসীন থাকাকালে বামেরাও কিন্তু ঠিক এই কথাই বলত। বিরোধীদের কোনও সংগঠন নেই, তাই প্রার্থী দিতে পারছে না বলে জানিয়ে সন্ত্রাসের যাবতীয় অভিযোগ বামেরা উড়িয়ে দিত। সে প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘এই বামেদের সঙ্গে সেই সময়ের তৃণমূলের তুলনা কোনও ভাবেই চলে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বিরোধী দলের আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস ছিল সে সময়ে। বামেদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যে ছিলেন মমতা।’’ তৃণমূল মহাসচিবের প্রশ্ন, ‘‘বর্তমানে যাঁরা বিরোধী শিবিরে রয়েছেন, তাঁরা কি আদৌ সে রকম কোনও সংগ্রামের মধ্যে রয়েছেন? সে সময়ের তৃণমূলের সঙ্গে আজকের বিরোধীদের তুলনা তা হলে হবে কী ভাবে?’’
পার্থবাবু যে প্রশ্নই তুলুন, অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখ থেকে দলকে রক্ষা করা কিন্তু কঠিন হয়ে দাঁড়াবে তাঁর পক্ষে। মনোনয়ন প্রত্যাহার হওয়ার আগেই যে ভাবে ২৭ শতাংশ আসনে শাসক দলের দখলদারি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখ কপালে তুলে দিচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy