এঁরাই হবু চিকিৎসক। ভবিষ্যতে এঁদের হাতেই হাজার হাজার রোগীর জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব থাকবে। আলাদা ওজন থাকবে এঁদের মতামতের। আগামী দিনে স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত পরিকল্পনা তৈরিতেও অংশ নেবেন এঁরা।
তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় চিকিৎসা গবেষণা সংস্থা ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এর সমীক্ষকদের তৈরি করা একটি রিপোর্ট রাজ্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা দফতরের কর্তাদের কাছে এসে পৌঁছোনোর পরে তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কারণ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমবিবিএস-এর পড়ুয়াদের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে গবেষকেরা জেনেছেন, প্রথম থেকে চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়াদের ৫৭% ঘোরতর ভাবে কোনও না কোনও নেশার কবলে। মদ-সিগারেট তো আছেই, এ ছাড়া রয়েছে গাঁজা, ভাঙ, আফিম। ঝিমুনি হয় এমন কিছু ওষুধ ও ডেনড্রাইট, জুতোর কালিও তালিকায় আছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, সব চেয়ে বেশি নেশাগ্রস্ত হচ্ছেন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়ারা।
২০১৫ সালের জুন থেকে এপ্রিলের মধ্যে মেডিক্যালের ৮০০ হবু ডাক্তারের উপরে চালানো এই সমীক্ষার রিপোর্ট ইতিমধ্যে ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’-এ প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে সমীক্ষকেরা হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখেছেন, ‘বিষয়টি উদ্বেগজনক। ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় এড়াতে কর্তৃপক্ষের এখনই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’ সমীক্ষক দলের প্রধান নরেন্দ্রনাথ নস্করের কথায়, ‘‘বছর কুড়ি আগে এই মেডিক্যাল কলেজের হবু ডাক্তারদের উপরে একই রকম সমীক্ষা করেছিলাম আমরা। তখনকার তুলনায় এখন দ্বিগুণেরও বেশি ছাত্রছাত্রী নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের নেশা করছেন বলে সমীক্ষায় পাওয়া যাচ্ছে।’’ সমীক্ষার ফল দেখে সতর্ক হয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশঙ্কা তাঁদের।
বছর আড়াই আগে এসএসকেএম ছাত্রাবাসে সপ্তর্ষি দাস নামে এক ইন্টার্নের নিষ্প্রাণ দেহ মিলেছিল। মাত্রাতিরিক্ত মাদক মেলে তাঁর শরীরে। বছরখানেক আগে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে কোরপান শাহকে পিটিয়ে মা রার ঘটনাতেও নেশাগ্রস্ত কিছু ছাত্র জড়িত ছিলেন বলেই অভিযোগ ওঠে। ফলে এই রিপোর্টকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য ভবন।
স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘খবরটা আগেই এসেছে আমাদের কাছে। চিন্তার বিষয়। ছাত্রছাত্রীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা সব মেডিক্যাল কলেজেই রয়েছে। তবে এই রিপোর্ট পাওয়ার পরে সব কলেজের অধ্যক্ষ ও ডিনদের আলাদা নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, কাউন্সেলিং ও ছাত্রদের উপরে নজরদারিতে কোনও ফাঁক থাকা চলবে না। নিয়মিত ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কলেজে বা হস্টেলে নেশার দ্রব্য ঢুকছে কি না, নজর রাখতে হবে। প্রতি রাতে অবশ্যই হস্টেল টহল দিতে হবে সুপারদের।’’
কেন এত নেশা করছেন হবু ডাক্তারেরা? সমীক্ষকদের কাছে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠ পড়ুয়া জানিয়েছেন, মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে নেশা করছেন। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ২০১২ সালে কলকাতার এক নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজের হবু চিকিৎসকদের মধ্যে অবসাদের প্রকোপ নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলেন মেডিক্যাল, এনআরএস, এসএসকেএম এবং বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিনের কিছু চিকিৎসক। তাতে দেখা গিয়েছিল, ৪২ শতাংশ মেডিক্যাল পড়ুয়া অবসাদে ভুগছেন এবং তাঁদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ অবসাদের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে বিভিন্ন রকম নেশা করছেন।
এসএসকেএমের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা বর্তমানে রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালগুলির দায়িত্বে থাকা প্রদীপ মিত্র অবশ্য ‘মানসিক চাপ’-এর তত্ত্ব মানতে নারাজ। তাঁর যুক্তি, আগে পড়াশোনার চাপ অনেক বেশি ছিল। ইন্টারনেট ছিল না, ভাল লাইব্রেরি ছিল না, অনেক বেশি পড়ুয়া ফেল করত, বাধ্যতামূলক হাউজস্টাফশিপ করতে হত। ‘‘আসলে সার্বিক ভাবে সমাজের অবক্ষয়ের প্রভাব ডাক্তারির ছাত্রদের উপরেও পড়ছে। ওই পড়ুয়ারা এটা বুঝছেন না যে, কোনও নেশাগ্রস্ত অন্য মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে পারেন না। উল্টে দায়িত্ব পেলে মেজাজ হারান।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের রেজিস্ট্রার কুন্তল বিশ্বাসের ব্যাখ্যায় আবার, ‘‘কেউ নিজেকে বীর প্রমাণ করতে খাচ্ছে, কেউ একসঙ্গে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ের মাঝখানে পড়ে হেরে যাওয়ার ভয়ে খাচ্ছে, কেউ আবার নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে নেশা ধরাচ্ছে যাতে সে ভাল করে পড়াশোনা করতেই না পারে।’’
তৃণমূল-প্রভাবিত প্রোগ্রেসিভ জুনিয়র ডাক্তার অ্যাসোসিয়েশন-এর স্টেট সেক্রেটারি রৌনক হাজারির মতে, অনেক মেডিক্যাল কলেজের বাছা বাছা কিছু হস্টেল নেশার আখড়া হয়ে উঠেছে। এর জন্য দায়ী অন্য কিছু ছাত্র সংগঠন। অন্য দিকে, এসএসকেএমে ডিএসও প্রভাবিত ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কবিউল হকের দাবি, শাসক দলের ছাত্র সংগঠনগুলির অনেক নেতা নিজেদের তরফে ছেলেমেয়ে টানতে নেশার জিনিস বিলি করেন। জেলায় বদলি হয়ে যাওয়ার ভয়ে হাসপাতাল বা হস্টেল কর্তারা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না। সন্ধ্যার পরে কোনও মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলে নজরদারিও থাকে না, ফলে অবাধে চলে নেশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy