—প্রতীকী ছবি।
‘‘ভাত খাচ্ছি। ডাল, পুঁইশাক, আচার, কাঁঠাল, কলা।” তৃপ্তির সুরে বলছিলেন পম্পি দাস। দেখে কে বলবে, এই মেয়ের আয়ু আর দিনকয়েক। ভিডিয়োয় ধরা জীবনের সেই ছন্দ, শেষ হলেও সব শেষ হতে দেয় না। এ যেন ফ্রান্জ় কাফকার সেই অমোঘ বাণীর দৃশ্যায়ন, ‘দ্য মিনিং অব লাইফ ইজ দ্যাট ইট স্টপস’। জীবন ক্ষণস্থায়ী। যেটুকু সময় আছে, জীবনকে উপভোগ করার কাজে লাগাও। কারণ, সময় শীঘ্রই ফুরোবে। বিশ্বাস করেছিলেন পম্পিও।
ডুয়ার্সে বেড়ে ওঠা সৌমেন দাসের জীবন জুড়ে বসত পম্পির। সুখের ঘরে অতর্কিতে হামলা চালায় ডিম্বাশয়ের ক্যানসার। ২০১৮ সালে। তার পরে এক বছর। তবুও হাসিমুখ ছিল পম্পির। ক্লান্ত যোদ্ধা চিরঘুমে যান ২০১৯-এ। জেগে আছেন তাঁর স্বামী, উত্তরবঙ্গের বানারহাটার এক চা বাগানের কর্মী সৌমেন। রোগের সচেতনতায় সবাইকে নিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে চলেছেন।
তাঁর স্বপ্ন, ডুয়ার্সের বুকে সরকারি ক্যানসার হাসপাতাল। যেখানে গরিব মানুষেরা চিকিৎসা পাবেন। কারণ, হতদরিদ্র শ্রমিক পরিবারে কর্কট রোগ বাসা বাঁধলে শহরে এনে বিনা খরচে চিকিৎসাও বিলাসিতা। হাসি অসময়ে ঝরে না পড়তে দেওয়ার অঙ্গীকারে বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে নীরবে প্রচার চালান ফিল্ড ওয়ার্কার সৌমেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রোজ সকালে চোখ যায় ফাঁকা দুটো কাঠের চেয়ারে।
সচেতনতায় গতি আনতে এক দিন সৌমেন ফোন ঘোরান অভ্রদীপ ঘটককে। বোঝালেন নিজের কথা, বললেন সবার হয়ে। অবসাদের মুহূর্তে ঢোকার আতঙ্কে থমকেও শেষে তথ্যচিত্র তৈরিতে মত দেন অভ্রদীপ। সৌমেনের মনে হয়েছিল, ক্যানসার-যুদ্ধে জয়ী উত্তরবঙ্গের ছেলে অভ্রদীপই পারবেন প্রচারের একটা মুখ হতে।
সংবাদমাধ্যমে দেড় দশকের অভিজ্ঞ অভ্রদীপের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা ২০১৪ সালে। সেই বছর জিভে ক্যানসার ধরা পড়ে। অস্ত্রোপচার, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপির পরে মূল স্রোতে ফেরার লড়াই শুরু। তাঁর প্রথম পরিচালনা ‘টান’। স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেই ছবি ২০১৬ সালে ক্যালিফর্নিয়ার এক চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত হয়েছিল।
ক্যানসার শল্য চিকিৎসক সায়ন পালও জলপাইগুড়ির ছেলে। তাঁর কথায়, ‘‘সমাজ থেকে ঘৃণা বা করুণা নয়। ক্যানসার রোগী এবং তাঁদের পরিজন যে লড়াই করছেন, তার শরিক হোন, কিংবা সহানুভূতি রাখুন। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে রোগ নির্মূল হয়। তার জন্য সচেতনতা জরুরি।’’ ক্যানসার যোদ্ধা, অভিনেতা চন্দন সেন জানালেন দু’দশকে এই রোগের চিকিৎসায় উন্নতির কথা।
ছবিতে এক প্রবীণ মুখ জানালেন, ২০০৬ সালে ক্যানসার ধরা পড়ার পরে চিকিৎসায় এখন তিনি সুস্থ। দোকানে বসে ব্যবসা করেন। তাঁর কথায়, ‘‘ক্যানসার একটা খেলা। যার দু’টি পক্ষ। এক পক্ষ জিতবেই। জিততে হলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।’’ সংসারের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত আর এক বৃদ্ধা বলছেন, ‘‘এখন আমি সুস্থ। আর পাঁচটা রোগের মতোই একটা ক্যানসার।’’
এমনই গল্পের মধ্যে দিয়ে এগোয় প্রায় ২২ মিনিটের স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র ‘লিভিং অন আ জেট প্লেন’। বৃহস্পতিবার নন্দনে ছবির প্রদর্শনের পরে সচেতনতার প্রসারে ছিল প্রশ্নোত্তর-পর্ব।
ছবিতে চা বাগানের বুক চিরে কাঁচা মাটির সর্পিল পথ যেনজীবন আর মৃত্যুর মাঝেরসেই সময়-সরণি, শুকনো পাতার শব্দ শুনেও যা উপভোগ করা যায়। আতঙ্কের গ্রাসে পথ চলা বন্ধ করলে মৃত্যুর আগেই নেমে আসে মৃত্যু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy