Advertisement
০২ মে ২০২৪
Calcutta Pavlov Hospital

পাশে নেই পরিজনেরা, তবু লড়ছেন পাভলভ ঘোরা ‘অপরাজিতা’ 

‘হাফওয়ে হোম’-এর হাত ধরে স্বাভাবিক জীবনের পথে ফিরেছেন যে মহিলা, তাঁর নাম পম্পা গুহ। বছর চল্লিশের পম্পা প্রত্যয় জীবন সহায়তা কেন্দ্রে এসেছিলেন গত জুলাই মাসে, কেন্দ্রটি শুরুর সময়েই।

An image of a woman

অদম্য: ভাড়া বাড়িতে পম্পা গুহ।  ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

নীলোৎপল বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৬
Share: Save:

মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল মুম্বই নিবাসী পাত্রের সঙ্গে। কিন্তু সেই দাম্পত্য জীবন সুখের হয়নি। পেশায় নির্মাণস্থলের কর্মী তাঁর স্বামী রোজই মারধর করতেন স্ত্রীকে। তত দিনে তাঁদের একটি মেয়ে হয়েছে। এর পরে এক সময়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় ঠাণের মানসিক রোগের হাসপাতালে। সেখান থেকে এক সময়ে মুক্তি পেলেও স্বামী আর দায়িত্ব নিতে চাননি। মেয়েকেও দেখতে পাওয়ার সুযোগ হয়নি। ব্যারাকপুরে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে এসেও সুরাহা হয়নি। আইনি লড়াই লড়ে মেয়েকে পেলেও সেই বাড়ি থেকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকা সেই মহিলাকে এর পরে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করায় পুলিশ।

তবু লড়াই ছাড়েননি মহিলা। পাভলভ থেকে সেরে উঠে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করলেও সম্ভব হয়নি। বাবা-মা আর তাঁকে নিয়ে যেতে চাননি। এর পরে তিনি আশ্রয় পান একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে চালানো রাজ্য সরকারের ‘হাফওয়ে হোম’ প্রকল্প ‘প্রত্যয়’ জীবন সহায়তা কেন্দ্রে। সেখানে শুধু থাকাই নয়, হাতেকলমে নানা কাজ শিখে নিয়ে নিজেই বালিগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্সিং অ্যাটেন্ড্যান্টের চাকরি জোগাড় করেন। প্রায় এক বছর ধরে সেখানে কাজ করার পরে সেই রোজগারের টাকায় এ বার একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার থেকে সুভাষগ্রামের সেই ঘরে থাকতে শুরু করেছেন ওই মহিলা।

মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় বললেন, ‘‘মানসিক হাসপাতালে যাঁরা সেরে উঠছেন, তাঁদের অনেকেরই কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। তাঁদের তখন অন্য মানসিক রোগীদের সঙ্গেই বাধ্য হয়ে হাসপাতালে থাকতে হয়। কিন্তু এটা কেন হবে? এই ভাবনা থেকেই গত বছরের জুলাই মাসে হাফওয়ে হোম তৈরি করা হয়। সেখানকার কেউ নিজের চেষ্টায় সমাজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাচ্ছেন, এর চেয়ে বড় সাফল্যের এবং আনন্দের আর কী হতে পারে! রাজ্য সরকারের সমাজকল্যাণ দফতর ও স্বাস্থ্য দফতরের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে, তাঁরা এই জীবন সহায়তা কেন্দ্রকে এখনও পর্যন্ত হাসপাতালের এক্সটেনশন হতে দেননি।’’

‘হাফওয়ে হোম’-এর হাত ধরে স্বাভাবিক জীবনের পথে ফিরেছেন যে মহিলা, তাঁর নাম পম্পা গুহ। বছর চল্লিশের পম্পা প্রত্যয় জীবন সহায়তা কেন্দ্রে এসেছিলেন গত জুলাই মাসে, কেন্দ্রটি শুরুর সময়েই। এই কেন্দ্রের কর্মী অভিজিৎ রায় বললেন, ‘‘পম্পা ছাড়াও আরও ২০ জন মহিলা এখানে রয়েছেন। মানসিক হাসপাতাল থেকে যাঁরা এখানে আসেন, তাঁদের প্রথমেই সাইকোমেট্রি পরীক্ষা হয়। সেই পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ নম্বর পেলে, ভারতীয় নাগরিক ও ৫৫ বছরের কম বয়স হলে এখানে আসা যায়। এর পরে যাঁরা আসতে ইচ্ছুক, তাঁদের কেন্দ্রটি ঘুরিয়ে দেখিয়ে জানানো হয়, জীবনের মূল স্রোতে ফেরার জন্য এখান থেকে তাঁরা কী কী শিখতে পারেন। তার পরে তাঁরা আসতে রাজি হলে নেওয়া হয়।’’ অভিজিৎ আরও জানান, শুরুতেই নানা থেরাপি করানো হয় আবাসিকদের। সেই সঙ্গে চলে পুতুল তৈরি, বাগান করার মতো হাতেকলমে কাজ শেখানো। তিন-চার মাস ধরে সেরামিকের কাজও শেখানো শুরু হয়েছে। আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে শেখানো চলছে ব্লক প্রিন্টিং, সেলাই এবং বেকিং।

এ দিন ভাড়ায় নেওয়া ঘর সাজানোর ব্যস্ততার মধ্যেই পম্পা বললেন, ‘‘কাজ শেখার মধ্যেই কোথাও না কোথাও কাজে যোগ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাই আমরা। কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে আবেদনও করি। হাতিবাগানে এক জায়গায় কাজের ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার অতীত নিয়ে লুকোছাপা করিনি। স্পষ্ট জানিয়েছিলাম, আমার জীবনে কী ঘটেছে। কিন্তু সেটা শোনার পরেই দারুণ ভাবে চলতে থাকা ইন্টারভিউ আর এগোয়নি।’’ এর পরে বললেন, ‘‘আমাদের দিদিমণিরা বলছিলেন, অতীতের কারণে কাজ না পাওয়ার ধাক্কায় আমার মনোবল ভেঙে যেতে পারত। কিন্তু আমি বলেছি, স্বামী, বাবা-মা কেউ পাশে থাকেনি। এই কাজটাই তো আছে। তাই কাজের জন্য যত দূর দরকার লড়ে যাব। শুধু মেয়েটার জন্য মনখারাপ হয়। এখন ওর ১৩ বছর বয়স। এক দিন এই ভাড়ার ঘরেই আমরা মা-মেয়ে থাকব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Calcutta Pavlov Hospital Life Struggle woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE