Advertisement
০১ মে ২০২৪
Death of Sister Cyril

শপথের মালা গাঁথল সিরিলের পরশমণি

সিরিলের লেখা ২০১৭ সালের বইয়ের নাম ‘গার্লস আর দ্য ফিউচার’। ডেরেক বললেন, “বইটা অবশ্যই আরও অনেকের পড়া উচিত। শুধু ইংরেজি নয়, এ বই বাংলা, মরাঠি, তামিল বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা হওয়া দরকার।”

An image of the dead body

কফিনে শায়িত সিস্টার সিরিল। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৩ ০৬:৪৪
Share: Save:

লোরেটো হাউসের পাশে সেন্ট টমাসের গির্জাঘরে গোলাপ, রজনীগন্ধার পাশে হলুদ, সাদা জারবেরা ফুলের সমারোহ। ঠিক তেমনই সিস্টার সিরিলের পার্থিব অবশেষ ঘিরে মঙ্গলবার বিকেলে অনেকগুলি পৃথিবীর রং মিশে গেল।

সন্ন্যাসিনী, শিক্ষাবিদ সিরিলের অন্ত্যেষ্টিকালীন প্রার্থনাসভায় রোমের সদর দফতর থেকে লোরেটো সন্ন্যাসীমণ্ডলের জেনারেল লিডার সিস্টার কারমেল সোর্ডসের লেখা চিঠি পড়া হল। পড়লেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় লোরেটো সিস্টার্সের প্রভিনশিয়াল লিডার সিস্টার স্যাব্রিনা এডওয়ার্ডস। তাতে কলকাতার গভীর শোকে প্রলেপের পাশাপাশি, ছক-ভাঙা শিক্ষক সিরিলের সৃজনশীল শিক্ষণ পদ্ধতির কথা বলা হল। কারমেলের কথায়, “কলকাতার গরিবের শিক্ষার প্রয়োজনে সিরিল অননুকরণীয় পদক্ষেপ করেন।” রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির উদ্ধৃতি দিয়ে কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডি’সুজাও বললেন, “সন্ন্যাসিনী সিরিলের জীবন মানে একনিষ্ঠ সমর্পণের ব্রত। দীনদরিদ্রের শিক্ষার অধিকার এবং ঈশ্বরের সেবায় তাঁর কাছে ফারাক ছিল না।” প্রত্যাশা মতোই এ অনুষ্ঠানের পুরোভাগে ছিল সিরিলের সন্তান তথা ছাত্রী সেই সাতরঙা মেয়ের দল, সিরিলের যত্নে নানা প্রতিকূলতার উজান ঠেলে যাঁরা ফুলের মতো বিকশিত হয়েছেন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা পড়ে সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনও সমাজ সংস্কারক, গরিবের বন্ধু সিরিলের কথা বললেন। সিরিলের লেখা ২০১৭ সালের বইয়ের নাম ‘গার্লস আর দ্য ফিউচার’। ডেরেক বললেন, “বইটা অবশ্যই আরও অনেকের পড়া উচিত। শুধু ইংরেজি নয়, এ বই বাংলা, মরাঠি, তামিল বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা হওয়া দরকার।” সিরিলের স্নেহধন্য ডেরেকের ইচ্ছে, এক বছরের মধ্যে সিরিলের বইটির বাংলা ভাষান্তর তিনি প্রকাশ করবেন।

মেয়েরাই ভবিষ্যৎ— সিরিলের এই উপলব্ধি যে কথার কথা নয়, তা মালুম হচ্ছিল গির্জাঘরের যে কোনও দিকে তাকালেই। সিরিলের রেনবো কন্যা রিঙ্কি সরকার বক্তৃতায় বললেন, “মাকে কোনও দিন দেখিনি! কিন্তু সিস্টার আমার জীবনে মা ছিলেন। তাঁর মায়া, মমতা, ভালবাসার পরশমণি নিজের জীবনে টের পেয়েছি!” সিরিল বিশ্বাস করতেন, সমান সুযোগ পেলে সব ছেলেমেয়েই সমান তালে এগোতে পারে। তাঁর এই প্রত্যয়ের ফলিত প্রয়োগই হল লোরেটোয় সিরিলের রেনবো হোম। পরিবারহীন মেয়েরাও সেই হোমে থেকে সকলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নানা সম্ভাবনার বর্ণে, গন্ধে প্রস্ফুটিত। ডেরেকও বলেন, রেনবো হোম মানে ছোটদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক। রিঙ্কি যেমন পুণের কলেজে সাংবাদিকতায় স্নাতক হয়ে বিলেতে পড়ার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টেস্ট দিচ্ছেন। প্রিয় সিস্টারের জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডেই তিনি যেতে চান।

রিঙ্কির মতোই উজ্জ্বল, আত্মবিশ্বাসী ঢঙে স্মরণসভায় দেখা গেল কারিমুন কোয়েল বা রাইমা খাতুনকেও। ওই দুই রেনবো কন্যা ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। কারিমুন এখন টিভি চ্যানেলে সাংবাদিকতা করছেন। প্রসাধনীর ব্যবসায় নামা রাইমা গড়িয়াহাটে নিজের দোকানের অধিশ্বরী। আমেরিকান কনসাল জেনারেল মেলিন্ডা পাভেক, কলকাতার সমাজকর্মী সমীর চৌধুরী, আয়ারল্যান্ড থেকে আসা সিরিলের ভাবশিষ্য মাইকেল হপকিন্সরা এক সুরে সিরিলের অবদানের কথা বলেন। সিরিলের স্মৃতিচারণ শোনা গেল লোরেটোর প্রাক্তনী বা শিক্ষিকা রেজা রশিদ, জ্যাকলিন রিবেরো, অমৃতা কর্মকার, বিদ্যা মুখোপাধ্যায়দের গলাতেও। সন্ধ্যায় সেন্ট জন’স সেমেট্রিতে সিরিলের কফিন মাটিতে ঢেকে যাওয়ার মুহূর্তে চারপাশ মথিত ‘আগুনের পরশমণি’ গানের সুরে। সিরিলের পরশমণি তখন যেন তাঁর কন্যাপ্রতিম ছাত্রীদের প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে পড়ল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Educationist Principal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE