এত দিন যে প্রশ্ন তুলে, আইনের বাধা দেখিয়ে অবৈধ নির্মাণ কাজ ঠেকাতে তৎপর হতেন পুরকর্মী, পুরসভার আধিকারিক, বাস্তুকাররা এ বার সেটাই বৈধ হতে চলেছে। যা শোনার পর শিলিগুড়ি-সহ উত্তরবঙ্গের অন্যান্য পুরসভাগুলিতে কর্মী আধিকারিকদের মধ্যে দিনভর বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন চলে।
কয়েক জনের প্রশ্ন, এত দিন নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে সে পরিমাণ জায়গা না ছাড়লে প্ল্যান আটকে দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে নির্মাণ কাজ দেখে যেখানে তা মানা হয়নি তাদের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এ বার নতুন আবাসন আইন কার্যকরি হলে সে সবই মেনে নিতে হবে। সরু রাস্তায় যেখানে বহুতল নির্মাণ করা যেত না এ বার আর সে সব ক্ষেত্রে বাধা থাকবে না। তা শুনে স্বভাবতই উৎসাহী প্রোমোটারেরা। তবে শহরের সচেতন বাসিন্দারা তাতে বিপদের আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে শিলিগুড়ির মতো উত্তরবঙ্গের বাণিজ্যের শহর শিলিগুড়িতে পুরসভা বসতি এলাকায় ভবনের ১০ শতাংশ জায়গা বাণিজ্যিক ব্যবহারের সুযোগ দিত। তার পরেও কারচুপি হত। সরকারের নতুন নিয়মে তা ৪৫ শতাংশ হওয়ায় আলাদা করে বসতি এলাকা বলে কিছু থাকবে না বলেই অনেকে আশঙ্কা করছেন।
শিলিগুড়ি এমনিতেই পরিকল্পনা মাফিক গড়ে ওঠেনি। গলি রাস্তার মধ্যে বহুতল গড়ে উঠছে। তার উপরে রয়েছে অবৈধ নির্মাণ। এমনকী বহুতলগুলি নিয়ম মাফিক জায়গা ছাড়ছে এমন অভিযোগে পুরসভার বোর্ড মিটিংয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। এ কারণে বিরোধী বাম কাউন্সিলর এমনকী তৃণমূল কাউন্সিলরদের একাংশের বাধাতেও অনেক নির্মাণ কাজ আটকে গিয়েছে। নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে এ বার যে হারে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকার নিচ্ছে তাতে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারের মতো শহরগুলি আরও বেশি ঘিঞ্জি এবং সমস্যা বহুল হয়ে পড়বে বলে বাসিন্দাদের বড় অংশের আশঙ্কা।
পুরসভার বাস্তুকারদের একাংশ মনে করেন, নতুন নিয়মে গলি রাস্তাগুলিতেও বহুতল নির্মাণের প্রবণতা বাড়বে। তাতে ওই এলাকায় চওড়া রাস্তা, সুষ্ঠু নিকাশি ব্যবস্থা-সহ অন্যান্য পরিষেবার পরিকাঠামো না বাড়ালে সমস্যা তৈরি হবে। কেন না ফ্লোর এরিয়া রেশিও-র ক্ষেত্রে বেশি ছাড় দেওয়ার অর্থ কোনও ভবনে বসবাসের এলাকা বাড়বে। বসবাসকারী লোকের সংখ্যা বাড়বে। পার্কিংয়ের জায়গা কমবে। খোলামেলা পরিবেশ নষ্ট হবে।
রাজ্যের নতুন নগরায়ণের নীতি রাজ্য জুড়ে প্রোমোটার এবং সিন্ডিকেট রাজকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিল বলে মনে করছেন রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। বুধবার অশোকবাবু শিলিগুড়ির দলীয় দফতরে সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, “আগামী ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চিটফান্ড বা বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থা থেকে টাকা আদায়ের রাস্তা শেষ হওয়ায় নতুন এই রাস্তা বাছা হয়েছে। অবাধে প্রোমোটারি ব্যবস্থার ছাড় দিয়ে ভোটের টাকা সংগ্রহের রাস্তা খোলা হল।” এতে শাসক দলের নেতাদের টাকা আদায়ের পথ আরও সুগম হল বলে অশোকবাবুর অভিযোগ। পুরসভার বিরোধী দলনেতা মুন্সি নুরুল ইসলাম বলেন, “এই নিয়মে পুর এলাকার গরিব বা মধ্যবিত্ত মানুষদের উপকার হবে না। প্রোমোটাররা উপকৃত হবেন, উৎসাহী হবেন। শহর থেকে গরিব মানুষ উচ্ছেদ হয়ে যাবেন।”
জলপাইগুড়ি শহরের প্রাণকেন্দ্র কদমতলার একটি বহুতল আবাসনের একাংশে নির্মাণ সম্প্রতি পুর কর্তৃপক্ষ নোটিশ পাঠিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। অভিযোগ নকশা না মেনে ফ্লোর এরিয়া রেশিও বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। পুরসভার অবৈধ নির্মাণের অংশ ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়। শান্তিপাড়ার একটি গলির রাস্তা বড়জোর ১৫ ফুট চওড়া। তার পাশে একটি আবাসন সংস্কারের কাজ শুরু হতেই পুর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে। ফ্লোর এরিয়া অন্তত দেড় গুণ বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ। একইভাবে রায়কতপাড়া, ডিবিসি রোডেও ভবন সংস্কারের সময় ফ্লোর এরিয়া অন্তত দ্বিগুণ করে নেওয়ার চেষ্টা হয় বলে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। সে সব ক্ষেত্রে পুরসভা নোটিসও পাঠায়। অথচ সরকারের নতুন নিয়মে এ সবই ছাড় পাবে বলে অভিযোগকারীরা হতাশ হয়েছেন। পুরসভার এক আধিকারিকের কথায়, “এতদিন ঠিক যে প্রশ্ন তুলে আইন দেখিয়ে বাধা দিয়েছি, এবার ঠিক সেই প্রশ্নকেই আইনসম্মত করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং অপ্রশস্ত রাস্তার দু’দিকের বা পাশের বাড়ি ঠোকাঠুকি হয়ে গেলেও কিছু করার নেই।”
প্রোমোটারদের রমরমা রাজ আমলের শহর কোচবিহারেও। গ্রাম্য শহরে কোথাও দশ তলা ছাড়িয়ে নির্মাণ কাজ চলছে। নতুন আবাসন আইনে আরও বেশি কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা বাসিন্দাদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy