Dasa Mahavidya

দশমহাবিদ্যার দশ রূপ কী কী?

মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছেন প্রজাপতি দক্ষ। সতী বিনা নিমন্ত্রণেই পিতৃগৃহে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। স্বামী মহেশ্বরের অনুমতি না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন দেবী। দশ দিকে, দশ রূপে তিনি আবির্ভূতা হন। এই রূপগুলিই দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত।

Advertisement
সৌভিক রায়
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ২২:২৯
Share:
০১ ১১

দশমহাবিদ্যা হল দেবী দুর্গার দশ রূপ। দক্ষকে বর দেন ব্রহ্মা, দক্ষ হয়ে ওঠেন বিভিন্ন প্রজাপতির অধিশ্বর। সেই খুশিতে বৃহস্পতি নামে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেন তিনি। মহাযজ্ঞে ত্রিলোকের সকলকে ও সমস্ত দেবতাকে নিমন্ত্রণ করলেও কন্যা সতী ও জামাতা শিবকে ডাকেননি দক্ষ। সতী বিনা নিমন্ত্রণেই পিতৃগৃহে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। স্বামী ভোলা মহেশ্বর অনুমতি দেননি। অনুমতি না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন দেবী। তখন শিবকে ভয় দেখানোর জন্য দশ রূপ ধারণ করেন তিনি। দশ দিকে, দশ রূপে দেবী আবির্ভূতা হন। এই রূপগুলিই দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত। কোনওটি ভীষণ দর্শনা, কোনওটি সৌম্য দর্শনা। আসুন জেনে নেওয়া যাক কী সেই দশ রূপ এবং তাদের তাৎপর্য।

০২ ১১

কালী: দশমহাবিদ্যার প্রথম রূপ কালী। তিনি সর্বসংহারকারিণী, শক্তির দেবী, শাক্তের আরাধ্যা। দেবীকে সৌম্য ও উগ্র দুই রূপেই বর্ণনা করা রয়েছে। শুম্ভ ও নিশুম্ভের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে দেবতাদের প্রার্থনায় দেবী দুর্গার ভ্রকুটি থেকে জন্ম হয় দেবী কালীর। চতুর্ভুজা দেবীর ডান দিকের দুই হাতে থাকে খড়্গ ও চন্দ্রহাস। বাম দিকের দুই হাতে থাকে চর্ম ও পাশ। গলায় নরমুণ্ড মালা, আলুলায়িত কেশরাশি, দেহ পশুচর্ম আবৃত, বড় বড় দাঁত, লোল জিহ্বা, রক্তচক্ষু ও বিস্তৃত মুখ, স্থুল কর্ণ– সব মিলিয়ে দেবী ভয়ঙ্কর দর্শনা। তাঁর বাহন কবন্ধ। তন্ত্রে বাহন মহাকাল।

Advertisement
০৩ ১১

তারা: দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় রূপ তারা। তিনি রক্ষাকারিণী, সিদ্ধিদাত্রী দেবী। তারিণীও বলা হয় তাঁকে। ভীষণ দর্শনা কালীর ভয়ে মহাদেব ভীত হলে সতী দ্বিতীয় বার আবির্ভূত হন তারা রূপে। দেবীর গায়ের রং নীল। পরিধান করেন ব্যাঘ্র চর্ম। চতুর্ভুজা দেবীর কণ্ঠে মুণ্ডমালা। জ্বলন্ত চিতার মধ্যে তাঁর অবস্থান। বাঁ পা শিবের বুকে তুলে তিনি দণ্ডায়মান। তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে দেবী তারা হলেন মহানীল সরস্বতী। ভারতের মাটিতে ঋষি বশিষ্ঠই প্রথম দেবী তারার উপাসনা করেছিলেন।

০৪ ১১

ছিন্নমস্তা: দশমহাবিদ্যার তৃতীয় রূপ হল ছিন্নমস্তা। এই রূপই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। স্বামীকে ভয় দেখাতে দেবী এই রূপ ধারণ করেছিলেন। তিনি স্বহস্তে নিজের মাথা কেটে নিজ রক্ত পান করেন। বাম হাতে ধরে থাকেন নিজেরই ছিন্ন মস্তক। তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের তিন ধারার মাঝের ধারা সেই ছিন্ন মস্তক পান করে। বামে সহচরী ডাকিনী ও ডানে সহচরী বর্ণিনী বাকি দুই রক্তধারা পান করে। সবাই দিগম্বরী, মুণ্ডমালিনী ও মুক্তকেশী। রতি ও কামদেবের উপর দেবী দণ্ডায়মান। চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমান শক্তির প্রতীক দেবীর তৃতীয় রূপ। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, দেবী পার্বতী তাঁর দুই সহচরী ডাকিনী ও বর্ণিনীকে নিয়ে মন্দাকিনী নদীতে স্নান করতে যান। স্নানরতা দুই সহচরী বলে ওঠেন, ‘আমরা ক্ষুধার্ত, আমাদের ক্ষুধা নিবৃত্তি কর।’ ডাকিনী ও বর্ণিনী রক্ত ও মাংস ছাড়া অন্য কিছু খায় না। দেবী নিজের নখাগ্র দিয়ে নিজ কণ্ঠচ্ছেদ করলেন। কণ্ঠ থেকে তিনটি ধারায় রক্তস্রোত বইতে শুরু করল। দেবীর দুই পাশে দাঁড়িয়ে দুই সহচারী সেই দুই রক্তধারা পান করতে লাগল। মধ্য ধারা দেবীর ছিন্ন মস্তক পান করল।

০৫ ১১

ষোড়শী: দশমহাবিদ্যার চতুর্থ রূপ ষোড়শী। দুর্গার অন্য রূপ শতাক্ষীর দেহ থেকে আবির্ভূতা হন ষোড়শী। তাঁর অপর নাম স্ত্রী বিদ্যা। ললিতা, মহাত্রিপুরাসুন্দরী, রাজরাজেশ্বরী, বালাপঞ্চদশী ইত্যাদি নাম রয়েছে দেবীর। চতুর্ভুজা দেবীর চার হাতে থাকে পাশ, অঙ্কুশ, ধনুক ও বাণ। দেবীর গায়ের রং নবারুণের আভার মতো। সৌম্যমূর্তি ষোড়শী হলেন হিরণ্যগর্ভ শিবের শক্তি। মহাদেবের নাভিপদ্মের উপরে কমলাসনে শান্তমুদ্রায় আসীন দেবী। নীচে দেবতারা স্তব করছেন। শঙ্করাচার্য এই দেবীর পুজো করেছিলেন।

০৬ ১১

ভুবনেশ্বরী: দশমহাবিদ্যার পঞ্চম রূপ ভুবনেশ্বরী। তাঁর সঙ্গে থাকার জন্যই শিবের আর এক নাম ভুবনেশ্বর। দেবী শাকম্ভরী এবং শতাক্ষী নামেও পরিচিত। তন্ত্রশাস্ত্র অনুসারে, মহাদেবের উপর অভিমানে দেবী ষোড়শী রূপ ধারণ করেন। শিবের বক্ষে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজেই ভীত হন। সেই ছায়া নিজের জেনে দেবী স্থিতধী হন। সেই রূপই হল ভুবনেশ্বরী। দেবী রক্তবর্ণা এবং চতুর্ভুজা। হাতে থাকে অঙ্কুশ এবং পাশ ও বরাভয় মুদ্রা। চার দিকে চার জন দেবী ভুবনেশ্বরীকে ঘিরে থাকেন। তাঁর আরও সহচরী আছে।

০৭ ১১

ভৈরবী: দশমহাবিদ্যার ষষ্ঠ রূপ ভৈরবী। কালভৈরবের শক্তিই ভৈরবী। দেবী ত্রিপুরেভৈরবী নামেও পরিচিত। চৌষট্টি যোগিনীর প্রধান ভৈরবী। ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে এই দেবী হলেন গুপ্ত যোগিনীদের অধিষ্ঠাত্রী। দেবী রক্তবর্ণা, রক্তবস্ত্র পরিধান করে তিনি পদ্মাসনে আসীন। গলায় থাকে মুণ্ডমালা। দেবী রজোগুণসম্পন্না সৃষ্টির প্রতীক। বিদ্যা ও ধনদাত্রী দেবী চতুর্ভুজা, অস্ত্রহীনা। তাঁর বাম হাতে পুস্তক ও অভয় মুদ্রা। ডান হাতে বরমুদ্রা ও জপমালা।

০৮ ১১

ধূমাবতী: দশমহাবিদ্যার সপ্তম রূপ হল দেবী ধূমাবতী। আবার অলক্ষ্মী, জ্যেষ্ঠাদেবী ইত্যাদি নামেও দেবী পরিচিতা। আগুনে জগৎ ধ্বংসের পর ভস্মাবশেষ থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয়, তার স্বরূপ হলেন ধূমাবতী। দেবী স্বয়ং নিয়ন্ত্রিতা। তাঁর কোনও প্রভু বা স্বামী নেই। তাই তাঁকে বিধবারূপে কল্পনা করা হয়। ভয়ঙ্করী, বৃদ্ধা, অপরিচ্ছন্ন বস্ত্র পরিহিতা, মুক্তকেশী, দ্বিভুজা, ধূমাবতী কাকধ্বজ চিহ্নিত রথে অধিষ্ঠান করেন। তাঁর হাতে থাকে শূর্প। আবিশ্ব ক্ষুধা থাকে তাঁর চোখে-মুখে। কৈলাসে এক দিন দেবী পার্বতী ক্ষুধায় কাতর হয়ে বারবার শিবের কাছে অন্ন চান। ঘরে অন্ন নেই। ক্ষুধা উপশমের জন্য শিব কিছুই দিতে পারেননি দেবীকে। ক্ষুধার জ্বালায় শিবকেই গ্রাস করেন দেবী। তৎক্ষণাৎ তাঁর দেহ থেকে ধোঁয়া নির্গত হতে থাকে। ধোঁয়ায় আবৃত দেহ থেকে শিব বার হয়ে বলেন, ‘তুমি যখন আমাকে গ্রাস করেছ, তখন তুমি বিধবা হয়েছ। এই বেশে ধূমাবতীরূপে তুমি পূজিতা হবে।’

০৯ ১১

বগলামুখী: দশমহাবিদ্যার অষ্টম রূপ বগলা। পরমাত্মার সংহারশক্তি হলেন বগলা। তন্ত্রে স্তম্ভনশক্তিকে বগলামুখী বলা হয়। দৈত্য রুরুর পুত্র দুর্গম, দেবতাদের চেয়ে শক্তিধর হওয়ার জন্য ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে বর লাভ করেন। দুর্গমের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে দেবতারা তখন দেবী ভগবতীর আরধনা করেন। দেবী আবির্ভূতা হয়ে যুদ্ধে দুর্গম অসুরকে পরাজিত করেন। বাম হাতে দুর্গমের জিহ্বা ধরে ডান হাতে গদা দিয়ে বধ করেন তাকে। দেবীর গাত্র পীত বর্ণের, পীত বসন পরিহিতা। দ্বিভুজা দেবী সুধা সমুদ্রের মাঝে মণিময় মণ্ডপে রত্নময় সিংহাসনে উপবিষ্টা।

১০ ১১

মাতঙ্গী: দশমহাবিদ্যার নবম রূপ হল মাতঙ্গী। শিব হলেন মাতঙ্গ আর তাঁর শক্তি মাতঙ্গী। আবার ব্রহ্মযামল তন্ত্র অনুসারে মাতঙ্গ মুনির কন্যা হলেন দেবী মাতঙ্গী। মাতঙ্গ মুনির আশ্রমে দেবতাদের আরাধনায় মাতঙ্গ মুনির স্ত্রীর শরীর থেকে বার হয়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন মাতঙ্গী। দেবী শ্যামবর্ণা, ত্রিনয়না, চতর্ভুজা ও রত্ন সিংহাসনে উপবিষ্টা। চার হাতে থাকে পাশ, অঙ্কুশ, খেটক ও খড়গ। ভক্তদের অভিষ্ট ফলদায়িনী দেবী হিসেবে পরিচিত মাতঙ্গী।

১১ ১১

কমলা: দশমহাবিদ্যার শেষ বা দশম রূপ হল কমলা বা কমলেকামিনী। কমলা হলেন ঐশ্বর্য লক্ষ্মী। চৈতন্যের দেবী কমলেকামিনী। তাঁর সৃষ্টি সমুদ্র মন্থনের সময়ে। সমুদ্রের মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্মে আসীন হন চতুর্ভুজা দেবী। দুই হাতে পারিজাত পুষ্প, বাকি দুই হাতে অভয় ও বরমুদ্রা। দুই পাশে দুইটি হাতি শুঁড় দিয়ে কলসে জল ভরে দেবীকে স্নান করান। সওদাগর পুত্র সুমন্ত সিংহলে যাওয়ার সময়ে এই রূপ দেখেছিলেন। ভার্গবদের দ্বারা দেবী পূজিতা বলে তাঁর অপর নাম ভার্গবী। স্থিরলক্ষ্মী ও সুখ-সমৃদ্ধি পাওয়ার জন্য দেবীর আরাধনা করা হয়। (এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement