Kali Yantra

এক গোয়ালিনীকে দেখে তৈরি হয় কালীমূর্তি! তার আগে কীসে পূজিত হতেন দেবী?

দক্ষিণা কালীর যে রূপে পূজিতা হন তার বয়স খুব বেশি হলে ৪০০ বছর।

Advertisement

রাজা পোদ্দার

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৫৭
Share:

প্রতীকী চিত্র।

লিকাং দক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালাবিভূষিতাম্।।

Advertisement

সদ্যচ্ছিন্নশিরঃ খড়্গ বামাধোর্ধ্ব করাম্‌বুজাম্।

অভয়ং বরদঞ্চৈব দক্ষিণাৰ্দ্ধোধ পাণিকাম্।।

Advertisement

মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চৈব দিগম্‌ম্বরীম্‌।

কণ্ঠাবসক্তমুণ্ডালীগলদ্রুধির চর্চ্চিতাম্‌।

কর্ণাবতংসতানীতশবযুগ্মভয়ানকাং।

ঘোরদংষ্ট্রাং করালাস্যাং পীনোন্নত পয়োধরাম্‌৷৷

কেমন দেখতে কালী?

কালীতন্ত্রে কালীর রূপবর্ণনা হচ্ছে এ ভাবেই। তবে কালীতন্ত্রে বর্ণনা যাই থাক আজ দক্ষিণা কালীর যে রূপে পূজিতা হন তার বয়স কিন্তু বেশি না। খুব বেশি হলে ৪০০ বছর। তা হলে তার আগে বঙ্গে শক্তিসাধনা হত কী ভাবে? কারণ বঙ্গদেশে শক্তিসাধনার ইতিহাস বহুপ্রাচীন।

এ প্রশ্নের উত্তরের আগে একটি প্রচলিত কাহিনীর বর্ণনা পড়ে নেওয়া যাক।

আজ যে দক্ষিণাকালী আমরা পূজিত হতে দেখি তাঁর রূপকার হলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। আনুমানিক ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’ গ্রন্থের রচয়িতা শক্তিপূজক আগমবাগীশ। কথিত আছে এক রাত্রে তিনি সারা রাত কালীর আরাধনা করে তাঁর দর্শন না পেয়ে প্রায় অর্ধন্মোদ অবস্থায় ভোর বেলায় গঙ্গাস্নানে যাত্রা করেন। পথে প্রায় অর্ধনগ্ন এক গোয়ালিনিকে তিনি দেওয়ালে ঘুঁটে দিতে দেখতে পান। অত ভোরে রাস্তায় কোনও জনমানব না থাকায় গোয়ালিনি বেরিয়ে ছিলেন ঘুঁটে দিতে। কিন্তু সামনে এক জন পুরুষ মানুষকে দেখে তিনি লজ্জায় জিভ কেটে ফেলেন। তার এক হাতে গোবর। তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন একটি কাঠের পাটাতনের ওপর। সেই অবস্থায় তাঁকে দেখে আগমবাগীশ পেলেন তাঁর ইপ্সিত আরাধ্যার রূপ। ফিরে এসে সেই আদলে কালীমুর্তি তৈরি করলেন তিনি। শিবের ওপরে দাঁড়িয়ে এক হাতে বারভয় মুদ্রা। কালীপুজোর রীতিনীতি নিয়ে লিখলেন ‘বৃহৎ তন্ত্রসার’। তবে তন্ত্রসার কেবল কালীপুজোই নয় তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা সহ একাধিক দেবদেবীর পূজাপাঠের বিধি রয়েছে। এর পর ‘তারারহস্য’, ‘শ্যামরহস্য’ বা ‘তারারহস্যবৃত্তিকা’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশ পেলেও তাতে সরল আকারে পূজাপাঠের নিদান ছিল না। তখনও গৃহে-গৃহে কালীপুজোর প্রচলন হয়নি। তার একটা সম্ভবত বড় কারণ এটাই, যে কী ভাবে কালীর আরাধনা বা পূজাপাঠ করা যায় তার কোন সহজ পদ্ধতি ছিল না। কার্তিকী অমবস্যায় দীপাবলি উৎসবে কালীপুজোর করবার রীতি, মন্ত্রাদি প্রথম সরল আকারে লেখেন কাশীনাথ। ১৭৬০ সালে কাশীনাথের লেখা ‘কালীসপর্যাবিধি’ জনপ্রিয় হয়। ঘরে ঘরে শুরু হয় কালীর আরাধনা।

তাহলে কালীমুর্তির আগে শক্তিআরাধনা হত কী ভাবে?

তখন শক্তিআরাধনা হত ঘটে এবং যন্ত্রে। সাধারণ গৃহে না হলেও বিভিন্ন পণ্ডিত বা যজমানদের গৃহে শক্তিআরাধনা হত মূলত ঘটে এবং যন্ত্রে।

কী এই যন্ত্র?

যন্ত্র হল জ্যামিতিক একটি ডায়াগ্রাম বা রেখাচিত্র। এই জ্যামিতিক রেখাচিত্রের মাধ্যমে উপাস্য দেবীকে আহ্বান করে ঘটে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তান্ত্রিক সাধনার এই অবিচ্ছেদ্য অংশ হল এই ডায়াগ্রাম।

তন্ত্রে সাধারণত বলা হয় কালী হলেন কাল। অর্থাৎ সময় বা সময়ের প্রতীক। তন্ত্রমত্রে এ সমগ্র বিশ্বচরাচর একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। সমস্ত শক্তি একে অপরের সমপৃক্ত। এই যে সমৃপক্তকরণ অর্থাৎ জগতের সমস্ত শক্তিকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার মাধ্যম হল এই রেখাচিত্র। অর্থাৎ জগতের সমস্ত শক্তিকে এই রেখাচিত্রের মাধ্যমে একই কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করা যায়। এ রেখাচিত্র আবার প্রকৃতির প্রতীকও বটে। বলা হয় এই যন্ত্র বস্তুগত এবং অতীন্দ্রীয় জগতের মধ্যে সেতুবন্ধন করে।

কালী যন্ত্রের ব্যাখ্যা

এই যন্ত্রের আঁকা হয়, বর্গক্ষেত্র, ত্রিভুজ, সমকেন্দ্রিক বৃত্ত, পদ্মের পাপড়ি সহযোগে। আর থাকে একটি কেন্দ্রিয় বিন্দু। এই বিন্দুই হল সমগ্র অস্তিত্বের প্রতীক। এই বিন্দুই সমগ্র ঐক্যকে বহন করে। এই বিন্দু ঘিরে যে রেখাচিত্র তা মহাবিশ্বের সমগ্র সৃষ্টি, সংরক্ষণ এবং ধ্বংসকে নির্দেশ করে।

পরস্পর সংযুক্ত ত্রিভুজগুলির বিশেষ তাৎপর্য আছে। নিম্নমুখী ত্রিভুজগুলি নারীশক্তির প্রতীক। আবার ঊর্ধ্বমুখী ত্রিভুজগুলি পুরুষশক্তির প্রতীক (শিব)। তন্ত্রমতে শক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শিবের সাথে মিলিত হন। এই দুয়ের মিলন মহাবিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টি এবং অন্তর্নিহিত ভারসাম্যকে রক্ষা করে।

যন্ত্রটি একটি বর্গক্ষেত্রের মত বেদির ওপরে বসানো থাকে। যাকে বলা হয় ‘ভপূর’। এর চারটে দরজা, যে দরজাগুলি যন্ত্রে প্রবেশাধিকার দেয়। এর পর আটটি পদ্মের পাপড়ি বা দল। যার মধ্যে ৫টি প্রকৃতির পাঁচ উপাদানের প্রতিনিধিত্ব করে- বায়ু, অগ্নি, জল, পৃথিবী এবং আকাশ। আর তিনটি তার গুণের প্রতিনিধিত্ব করে- সত্ত্ব, রজ, এবং তমস।

পাঁচটি উল্টোনো সমকেন্দ্রিক ত্রিভুজ মানুষের মননকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই অংশটি হল কর্ণিকা। যার মাঝে থাকে আত্মা (প্রধান বিন্দু) তাঁকে ঘিরে শরীর, জীবনশক্তি, মন, প্রজ্ঞা এবং আনন্দ। পাঁচটি ত্রিভুজের তিনটি করে মোট পনেরটি কোণের পাঁচটি মানব অঙ্গ, পাঁচটি মানব কর্ম এবং বাকি পাঁচটি তন্মাত্র অর্থাৎ- গন্ধ, স্বাদ, অনুভূতি এইগুলি প্রতিনিধিত্ব করে।

দুটি বৃত্ত জন্ম ও মৃত্যুর চক্রের প্রতিনিধিত্ব করে।

আবার এই যন্ত্রকে মহাবিশ্বের প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব হিসেবে দেখা হয়, যার কেন্দ্রে রয়েছেন স্বয়ং কালী। সৃষ্টি এবং লয় এর মহাজাগতিক শক্তি দ্বারা তিনি বেষ্টিত।

তন্ত্রে বলা হয় এই যন্ত্রের আরাধনার মাধ্যমে আরাধ্যকারী তার সমস্ত অহং ত্যাগ করতে পারেন। এ হল সেই প্রবেশদ্বার, যাঁর মাধ্যমে তিনি চেতনার এমন এক স্তরে পৌঁছন যেখানে, তাঁর আত্মা ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে মিলিত হতে পারে।

প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার এই যন্ত্রসাধনা খুবই কঠিন এক সাধনা। তার মন্ত্রও সাধারণ পুজোপাঠের মত নয়। যন্ত্র শুদ্ধিকরণের পর যথাযথ পূজা ও মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে সেখানে দেবীর অধিষ্ঠান করানো হয়।

কালী যন্ত্রে একাধিক রঙ-এর ব্যবহৃত হয়। লাল, হলুদ, কালো, ধূসর । লাল হল রক্ত এবং হৃদয়ের প্রতীক। কালো আঁধারের প্রতীক। আর ধূসর হল সেই আঁধার থেকে যখন আলো নির্গত হয়। স্বর্ণ বর্ণ হলুদ রূপান্তরের রং। বেদি বা ভপূর সাধারণ তামা, পিতল বা রূপো দিয়ে বানানো হয়।

পরিশেষে বলা যায় তন্ত্র মতে যন্ত্র আসলে সৃষ্টির প্রতীক। যন্ত্রের রকমভেদ আছে যেমন, শরীর যন্ত্র, মণ্ডল যন্ত্র, পূজা যন্ত্র, শান্তিকরণ যন্ত্র, স্তম্ভন যন্ত্র প্রভৃতি। বিভিন্ন যন্ত্রের আরাধনা পদ্ধতি ভিন্ন। আবার তন্ত্রপুরাণ মতে কালীর নয়টি রূপ- মহাকালী, দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, কৃষ্ণকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, শ্রীকালী, , চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী। আবার অভিনব গুপ্তর যে তন্ত্রলোক তাতে কালীর ১৩ টি রূপ। মহাকালী, সৃষ্টিকালী, স্থিতিকালী, সংহারকালী, চণ্ডকালী রক্তকালী, যমকালী, মৃত্যুকালী, রুদ্রকালী, পরমার্ককালী, মার্তণ্ডকালী, কালাগ্নিরুদ্রকালী, মহাভৈরবঘোর। এঁদের প্রত্যেকের সাধন পদ্ধতি আলাদ।

তবে কালী ছাড়া বিভিন্ন শক্তিসাধনারও অর্থাৎ বিভিন্ন শক্তিদেবীর বিভিন্ন যন্ত্র আছে। তাঁদের পুজোপাঠ এবং ব্যবহারিক পদ্ধতিও আলাদা।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement