প্রতীকী চিত্র
মহালয়ার সকাল মানেই রেডিয়োতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। আম বাঙালি মহিষাসুর বধের কাহিনি শুনত। কিন্তু কবে থেকে বাঙালি তা দেখা আরম্ভ করল? আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে মহালয়ার ভোর পেল আরও এক অনুষ্ঠান, ‘দনুজদলনী দুর্গা’। আকাশবাণীতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আর দূরদর্শনে ‘দনুজদলনী দুর্গা’। এই দুই অনুষ্ঠান ছাড়া যেন বাঙালির পুজো শুরুই হয় না! বেতারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রপাঠ শেষ হতেই পাড়ায় পাড়ায় চলতে শুরু করত টিভি। শ্রাব্যমাধ্যমের সঙ্গে সঙ্গে মহালয়ার সকালের অনুষ্ঠান উঠে এসেছিল দৃশ্যমাধ্যমেও। কিন্তু কখনওই একটি আর একটির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। সম্ভবত সম্প্রচারের সময় আলাদা হওয়াই এর কারণ।
১৯৭৫ সালে কলকাতা দূরদর্শনের সফর শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে কর্তৃপক্ষ ঠিক করেন, মহালয়ার ভোরে বিশেষ অনুষ্ঠান করা হবে। প্রযোজনার দায়িত্ব পান জগন্নাথ মুখোপাধ্যায় ও মালতী বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০, প্রথম পাঁচ বছর তাঁরাই দূরদর্শনে মহালয়ার এই বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন। বার বার বদল হয়েছে চিত্রনাট্যের, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও বদলে গিয়েছেন।
দূরদর্শনে দুর্গার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ভরতনাট্যম শিল্পী যামিনী কৃষ্ণমূর্তি, বর্ণালী দত্ত, অমিতা দত্ত, সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী হালদার, অপরাজিতা আঢ্য, মহুল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এমনকী ১৯৯৫ সালে তারকা-অভিনেত্রী হেমা মালিনীও দেবী দুর্গা হয়েছেন দূরদর্শনের জন্য। তবে এঁদের মধ্যে দেবী দুর্গার ভূমিকায় সবচেয়ে খ্যাতি পেয়েছেন সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৪ সালে প্রথম দুর্গার ভূমিকায় পর্দায় আসেন সংযুক্তা। ১৯৯৬ থেকে ২০১৩ অবধি তাঁকে দুর্গার বেশে দেখে এসেছে বাংলা। সংযুক্তার অভিনয় আজও দর্শক-মনে উজ্জ্বল।
কেবল কুশীলব নয়, বদলেছে নামও। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত দূরদর্শনের অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘ইয়া দেবী সর্বভূতেষু’। তাতে দেবী দুর্গা হতেন মালবিকা মিত্র। এর পরে ‘দনুজদলনী দুর্গা’, ‘অসুরদলনী দেবী দুর্গা’, 'দেবী দুর্গা’-- নানা সময়ে নানা নাম রাখা হয়েছে অনুষ্ঠানের। প্রযোজকের দায়িত্ব সামলেছেন ইন্দ্রাণী রায়, শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত, কল্যাণ ঘোষ, বিভাস পাল প্রমুখ। পঙ্কজ সাহা, সনৎ মহান্ত, কল্যাণ ঘোষরা পরিচালনা করেছেন। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, অধ্যাপক হীরেন চট্টোপাধ্যায়, অজয় ভট্টাচার্যরা স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। ১৯৮৫ থেকে ২০২৪, কখনও নতুন অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হয়েছে, কখনও পুনঃসম্প্রচার হয়েছে, কখনও আবার কয়েকটি অনুষ্ঠানকে মিলিয়ে নয়া রূপ দেওয়া হয়েছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্মশতবর্ষে তাঁর কণ্ঠই ব্যবহৃত হয়েছিল দূরদর্শনের স্তোত্রপাঠে।
চার দশক পেরিয়ে নানা বদল সয়ে আজও মহালয়ার সকালে মহিষাসুর বধের ঘটনাকে উপজীব্য করে দূরদর্শন নিবেদন করে যাচ্ছে, তাদের ‘মিউজ়িক্যাল প্রেজেন্টেশন’। দূরদর্শন একাধিপত্য হারিয়েছে বহু দিন। অজস্র চ্যানেল তৈরি হয়েছে। কিছু টিকে রয়েছে, অনেক চ্যানেলই বিলীন হয়ে গিয়েছে সময়ের গর্ভে। প্রত্যেকটি চ্যানেলই মহালয়ার ভোরে মহিষাসুর বধ পালা-নির্ভর কোনও না কোনও অনুষ্ঠান করে। কিন্তু দূরদর্শনের অনুষ্ঠান যেন আজও টেক্কা দেয় অন্যদের। রেডিয়োতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র পাশাপাশি দূরদর্শনের অনুষ্ঠানও যেন বাঙালির ঐতিহ্য হয়ে গিয়েছে। মিশে গিয়েছে বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির সঙ্গে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।