প্রতীকী চিত্র।
বাংলার ঘরে ঘরে কালীকে পৌঁছে দেওয়ার অন্যতম কারিগর কুমারহট্টের (অধুনা হালিশহর) রামপ্রসাদ সেন। তাঁর পদ অর্থাৎ সঙ্গীত যা ‘রামপ্রসাদী’ নাম পেয়েছে, তা পুজোর মন্ত্রের চেয়ে কম কিছু নয়। তান্ত্রিক ও ডাকাতদের আরাধ্যা দেবীকে অবলীলাক্রমে বাংলার মা ও মেয়ে করে তুলেছেন রামপ্রসাদ, মাধ্যম তাঁর গান। পল্লীবাংলার মাটি যেন তাঁর পদ, মেঠো পথ যেন তাঁর সুর, ক্ষেতের ফসল তাঁর সাধনা, নদীর জল তাঁর ভক্তি। রামপ্রসাদের সুফি-বাউল মনে কেবল কালীর বসবাস। তাই বেখেয়ালে তিনি হিসাবের খাতায় শ্যামা মায়ের পদ লিখে ফেলেন। দেবী তাঁর কন্যা হয়ে বেড়া বাঁধতে আসেন। কথিত, শ্যামানগরের কালী রামপ্রসাদের কাছে গান শুনতে চেয়েছিলেন। গঙ্গাবক্ষে নৌকায় বসা রামপ্রসাদ নাকি বলেছিলেন, ‘আমি গান শোনাতে যেতে পারব না। তুই ওখানে (মন্দির) বসেই শোন।’ জনশ্রুতি আছে, দেবী মূর্তি নাকি সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গার দিকে ঘুরে গিয়েছিল। দেবীকে এমন হুকুম জারি কে করতে পারেন? এ ভাবেই গানের কলিতে কালী হয়ে উঠছেন তাঁর মেয়ে। আবার স্বয়ং কালী তাঁকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, রক্ষা করেছেন ভয়ঙ্কর ডাকাতের কবল থেকে। অভাব, অনাহারে রামপ্রসাদ বিচলিত হননি কালীকে স্মরণ করে। মা কালীর সঙ্গেই বিলীন হয়ে যান তিনি। বৈশাখী পূর্ণিমায় কালী মূর্তি বিসর্জন দিতে গিয়ে কুমারহট্টের গঙ্গায় তলিয়ে গিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। লোকে বলে, মা-ই ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন। মা-ব্যাটার এমন সম্পর্কের দলিলই যেন রামপ্রসাদের পদ।
রামপ্রসাদ আঠারো শতকের মানুষ। মনে করা হয়, ১৭১৮-১৭২০ সালের মধ্যে তাঁর জন্ম। বাবা কবিরাজ রামরাম সেনের মৃত্যু হলে রামপ্রসাদ কলকাতার দর্জিপাড়ার বিত্তবান দুর্গাচরণ মিত্রের সেরেস্তায় কেরানির কাজ শুরু করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, কাছারির হিসাবের খাতায় পদ লিখতেন তিনি। কাজে ফাঁকি দিয়ে কাব্য লেখা! অন্যান্য কর্মচারীরা মালিকের কাছে রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানান।
কিন্তু দুর্গাচরণ মিত্র তাঁর রচনাগুলি পড়ে মুগ্ধ হয়ে যান। ‘আমায় দে মা তবিলদারি।/ আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী।।/ পদরত্ন ভাণ্ডার সবাই লুটে, ইহা আমি সইতে নারি।/ ভাঁড়ার জিম্মা যার কাছে মা, সে যে ভোলা ত্রিপুরারি।/ শিব আশুতোষ স্বভাব দাতা, তবু জিম্মা রাখো তাঁরি।/ অর্ধ নগ্ন জায়গির তবু শিবের মাইনে ভারি।’— কী করে এমন লিখলেন এক জন কেরানি? দুর্গাচরণ বুঝলেন রামপ্রসাদের প্রতিভা। কেরানির কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে রামপ্রসাদকে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন দুর্গাচরণ। তাঁর মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করলেন। রামপ্রসাদকে চিনেছিলেন আরও এক জন। নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন রামপ্রসাদ। সাধক-কবিকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিও দিয়েছিলেন নদিয়াধিপতি। লোককাহিনি অনুযায়ী, নবাব সিরাজদৌল্লাকেও মুগ্ধ করেছিল তাঁর গান।
সেরেস্তায় চাকরি ছেড়ে গ্রাম ফিরে পঞ্চমুণ্ডির আসন গড়ে সাধনা শুরু করেন রামপ্রসাদ। সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে কলম। কত গান যে তিনি লিখেছেন, তার ইয়ত্তা করা যায় না। তবে সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ ছত্রে ছত্রে ছিল ঈশ্বর প্রেম আর ভক্তি। কালী ভক্তিতে সিক্ত তাঁর হৃদয়। লিখছেন—‘ডুব দে মন কালী বলে।/ হৃদিরত্নাকরের অগাধ জলে।।’ কালীর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস, ভরসা। তাই তো লিখেছেন— ‘কালী নামে দাও রে বেড়া ফসলে তছরুপ হবে না,/ সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া তার কাছেতে যম ঘেঁষে না।’ কালীর ভাব-আবেশে জীবন দর্শনকেও ধরেছেন গানে। ‘ভেবে দেখ মন কেউ কারও নয়’, ‘শ্যামা মা উড়াচ্ছো ঘুড়ি/ এ ভবসংসার বাজারের মাঝে’, ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’, ‘তিলেক দাঁড়া ওরে শমন’ ইত্যাদির মতো গানগুলি তার প্রমাণ।
আবার গানে কালীর কাছে অনুযোগও করছেন তিনি। কৃষ্ণচন্দ্র রায় মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত। অন্য দিকে, রানাঘাটের পান ব্যবসায়ী কৃষ্ণপান্তি (পান ব্যবসায়ী বলে পান্তি। আদত পদবি পালচৌধুরী) পাচ্ছেন জমিদারি। রামপ্রসাদের কলমে জন্ম নিল, ‘প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তার নামেতে নিলাম জারি।/ঐ যে পান বেচে খায় কৃষ্ণপান্তি– তারে দিলি জমদারি।।’ এ যেন ঝরে পড়ছে অভিমান। কালীকে কাঠগড়ায় তুললেও দ্বিধা নেই তাঁর। —‘হুজুরে দরখাস্ত দিতে, কোথায় পাব টাকাকড়ি।/ আমায় ফকির বানায়ে, বসে আছে রাজকুমারী।/হুজুরে উকীল যে জনা, ডিসমিস তাঁর আশায় ভাবি।/ করে আসল সন্ধি সওয়ালবন্দী— যে রূপেতে আমি থরি।।/ পালাইতে স্থান নাই মা, বল কিবা উপায় করি।/ ছিল স্থানের মধ্যে অভয় চরণ, তাও নিয়াছেন ত্রিপুরারি।।’
মন্বন্তর, মহামারি, বর্গীহামলা, পলাশীর যুদ্ধ– বহু ঘটনা ঘটেছে আঠেরো শতকে। দেখেছিলেন কবি। বাংলায় দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা দেখে আবেগী রামপ্রসাদ লিখলেন— ‘অন্নপূর্ণা মা থাকিতে মোর ভাগ্যেতে একাদশী।’ খাদ্যের প্রার্থনা করে লিখছেন— ‘অন্ন দে গো অন্ন গো, অন্ন দে/ জানি মায়ে দেয় ক্ষুধার অন্ন অপরাধ করিলে পদে পদে।’ তাঁর গানে এসেছেন দুর্গাও। তবে কালী পদকর্তা হিসাবেই রামপ্রসাদ জনপ্রিয় ও স্মরণীয়। তাঁর ধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, নজরুল ইসলাম এবং স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
আজও আপামর বাঙালিকে মুগ্ধ করে রামপ্রসাদের গান। কেন করে?
রবি ঠাকুরের কথা থেকে ঋণ নিয়ে বলতে হয়। আত্মীয়ের মতো ঈশ্বরের সঙ্গে মান-অভিমান করেছেন রামপ্রসাদ। তিনি যে সত্যি সত্যি দেবী কালীকে নিজের আত্মীয় ভাবতেন, তার প্রমাণ মেলে তাঁর গানে। গানের কথায়, সুরে, আবেগে-ভাবে কোনও বিচ্যুতি নেই। এ জিনিস আন্তরিক আত্মীয়তার ফসল। এই আন্তরিকতাই সাধক-কবির গানের শক্তি, গানগুলি কালোত্তীর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।