International News

‘একাত্তরের জননী’ রমা চৌধুরী প্রয়াত চট্টগ্রামের হাসপাতালে

গল ব্লাডারে পাথর, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ-সহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে রমা চৌধুরী গত বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রবিবার সন্ধ্যায় শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে রাতে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। সেখানেই প্রয়াত হন তিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ঢাকা শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৫:৪৪
Share:

প্রয়াত রমা চৌধুরী। ফাইল ছবি

রমা চৌধুরী— একাত্তরের জননী। খালি পায়ে হেঁটে চট্টগ্রামে তিনি বিক্রি করতেন নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধের বই। আর সেই বই বিক্রির টাকাতেই ছিল তাঁর দিনযাপন, বেঁচে থাকা। সেই জননী, বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী আজ চলে গেলেন সবাইকে কাঁদিয়ে। সোমবার ভোর ৫টা নাগাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি। বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

Advertisement

গল ব্লাডারে পাথর, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ-সহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে রমা চৌধুরী গত বছরের ১৫ জানুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রবিবার সন্ধ্যায় শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে রাতে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। সেখানেই প্রয়াত হন তিনি।

১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক হন রমা চৌধুরী। পরে শিক্ষকতা করতেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালি উপজেলার পোপাদিয়ার একটি স্কুলে। লেখালেখি শুরু তখন থেকেই। তাঁর ‘একাত্তরের জননী’ বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচুর ঝড়ঝাপটা এসেছে। এসেছে অর্থসঙ্কটও। দান দক্ষিণা না নিয়ে, রমা চৌধুরী শুধুমাত্র নিজের বই বিক্রির টাকাতেই জীবন কাটিয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো মোটা টাকা দিয়ে সহায়তাও করতে চেয়েছেন, কিন্তু তিনি তা নেন নি। তার শর্ত একটাই- যত টাকা দেবে, বিনিময়ে সেই টাকার পরিমাণ বই নিতে হবে। এ ছাড়া তিনি কোন অর্থ নিতেন না।

Advertisement

আরও পড়ুন: নিজের রেকর্ড নিজেই ভাঙলেন পঁচানব্বইয়ের এই স্কুবা ডাইভার

১৩ মে ১৯৭১ রাজাকার আর পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে ঢুকে রমার মা, দুই ছেলে সাগর ও টগরের সামনেই তাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণেই ক্ষান্ত হয়নি পাকিস্তানি হানাদাররা- রমাদের বাড়িটাও পুড়িয়ে দেয় তারা। কোনও মতে মুক্ত হয়ে রমা পুকুরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন— চোখের সামনে দেখেন গান পাউডারের আগুনে পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ির লেলিহান শিখা। মুক্তিযুদ্ধের বাকি আটটি মাস তিনি লুকিয়ে বেড়িয়েছেন সন্তান আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে। মায়ার টানে রাতে পোড়া বাস্তভিটায় এসে মাথা গুঁজতেন খড়কুটো বা পলিথিনে।

আরও খবর: বাবার শেষকৃত্যে ট্রাম্পকে একহাত ম্যাকেন-কন্যার

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই দগদগে স্মৃতি, আর দেশ স্বাধীন হবার ৫ দিন পরই সন্তান হারানোর শোক তাঁকে স্তব্ধ করে দিলেও থামিয়ে রাখতে পারেনি। সেই শোক আর কষ্টগুলো তিনি অক্ষরবৃত্তে সাজিয়ে সেই বই ফেরি করে বিক্রি করতেন। সন্তান যে মাটিতে শুয়ে সেই মাটির উপরে জুতো পায়ে পথ চলেননি কখনও। তাঁর কথায় যে মাটিতে শুয়ে প্রিয় সন্তান, যে মাটির জন্য নির্যাতিত হয়েছেন তিনি, সে মাটিতে কি ভাবে জুতো পায়ে হাঁটবেন!
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার পর ২০ ডিসেম্বর রাতে শ্বাসকষ্টে মারা যায় তাঁর সন্তান সাগর। 'একাত্তরের জননী' বইটির ২১১তম পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, “ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ করে কাঁদতে থাকেন, আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)।”
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রমা চৌধুরী আর এক ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গেলে, শ্বাসরোধ হয়ে সেই সন্তানেরও মৃত্যু হয়। তাঁর আর এক সন্তান টুনু চট্টগ্রামের বোয়ালখালিতে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সন্তান হারানোর পর থেকে খালি পায়ে পথ চলা শুরু। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, “আমার ছেলেদের আমি পোড়াতে দিইনি। এই মাটিতে তারা শুয়ে আছে। আমি কী ভাবে জুতা পায়ে হাঁটি। পারলে তো বুক দিয়ে চলতাম-ফিরতাম।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন