বাঙালির প্রিয় রহস্যময়ী

বাড়ির সকলে কৃষ্ণা বলে ডাকতেন, স্কুলে ভর্তির সময় তার নাম দেওয়া হয় রমা। ক্লাস নাইন-এ পড়ার সময় দু’টি ক্লাসের মাঝখানে ডেস্কের উপর বসে গল্প করতে-করতে বন্ধুদের একদিন হঠাৎ বলে ফেলেছিলেন ‘আমি এমন নাম করব যে, পৃথিবী চিরকাল আমায় মনে রাখবে।’

Advertisement

শিলাদিত্য সেন

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share:

একান্তে: সঙ্গী যখন রবীন্দ্ররচনা। ছবি বই থেকে

সম্পূর্ণ সুচিত্রা

Advertisement

আনন্দলোক সংকলন

মূল্য: ৪৫০.০০

Advertisement

প্রকাশক: আনন্দ

বাড়ির সকলে কৃষ্ণা বলে ডাকতেন, স্কুলে ভর্তির সময় তার নাম দেওয়া হয় রমা। ক্লাস নাইন-এ পড়ার সময় দু’টি ক্লাসের মাঝখানে ডেস্কের উপর বসে গল্প করতে-করতে বন্ধুদের একদিন হঠাৎ বলে ফেলেছিলেন ‘আমি এমন নাম করব যে, পৃথিবী চিরকাল আমায় মনে রাখবে।’ সেই রমা যখন সত্যি নাম করে ফেললেন সিনেমায়, হয়ে উঠলেন সুচিত্রা, উমাদেবী— তাঁর দিদি একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুই সিনেমায় নামলি, অভিনয়ের কী জানিস?’ নিজের দিদির কাছে সবচেয়ে সহজ ছিলেন সুচিত্রা, অকপটও, বলেছিলেন ‘না দিদি, পয়সার খুব দরকার, সিনেমা করতেই হবে। চেষ্টা করে দেখি, কতটা পারি।’ কতটা পেরেছিলেন তা বোধহয় শুধু বঙ্গদেশের মানুষজনই নন, আদিগন্ত ভারতবাসী জানেন— সাদাকালো চলচ্চিত্রে তিনি চিরন্তন বর্ণময়ী।

আবার যখন ১৯৫৩-’৭৮ পর্যন্ত দর্শকের চোখে স্বপ্নে-স্বপ্নে ফেরার পর স্বেচ্ছাবসর নিয়ে চলে গেলেন অন্তরালে, কেউই প্রায় জানতে পারল না কারণটা। কেবল তাঁর ছায়াসঙ্গী মহম্মদ হাসান জামান ছাড়া, যিনি ছিলেন তাঁর মেকআপ আর্টিস্ট, হয়ে উঠেছিলেন খুব কাছের মানুষ। একদিন জামান খুব মনখারাপ ক’রে বাড়ি ফিরে স্ত্রী জামিলাকে বললেন, সুচিত্রা আর অভিনয় করবেন না, আর না-করার যে কারণটি জানিয়েছেন, সেটি শুনে চমকে ওঠার মতো। শত অনুরোধেও জামান কিন্তু কারণটি বলেননি জামিলাকে: ‘ও ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলেছিল, ওকে যেন এই বিষয়ে কোনও প্রশ্ন না করি’।

বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠার মতোই অপরিহার্য এই আনন্দলোক সংকলন-টি, গ্ল্যামার-গসিপ-এ মোড়া বাঙালির এত বড় মাপের আইকন-টিকে ঠিক মতো চেনা বা বোঝার জন্যে বিবিধ তথ্যে, অজানা কথায়, এতাবৎ অনুচ্চারিত স্মৃতিলেখতে পেশ করেছে পাঠকের কাছে। দুর্ভেদ্য কেল্লার বাসিন্দা বা দেবী হয়ে নয়, রক্তমাংসের সুচিত্রা হয়েই এ বইতে আত্মপ্রকাশ বাঙালির প্রিয় রহস্যময়ীর। আড়াল তাঁর প্রিয় ছিল, আত্মজীবন লিখতে চাননি, তাঁর কথা কেউ কখনও যেন জানতে না পারে— এমনই বিধান দিয়েছিলেন, বারণ রেখে গিয়েছেন, তবু তাঁকে নিয়ে আনন্দলোক-এ বেরনো বিভিন্ন সময়ের রচনাদি তাঁর অলিখিত জীবনকেই গোচরে এনে দিল সকলের। অপরিণত মহাজীবনীর বদলে নিশ্চিন্তে এ-বই নির্ভর করে কোনও পারঙ্গম সাহিত্যিক কিংবা চলচ্চিত্রকার আখ্যানের মতো ভেবে ফেলতে পারেন সুচিত্রার জীবনী, যা এক বাস্তব মানুষের গল্প।

সে বাস্তবতায় ধরা পড়ে যান স্বয়ং উত্তমকুমারও, সুচিত্রার ক্রমোন্নতি ও সাফল্যে ঈষৎ ঈর্ষান্বিত, এক বন্ধুকে চিঠিতে লিখছেন ‘আপনাদের সুচিত্রা সেন মুম্বইতে আরও দু’-তিনখানা বই-এ কনট্র্যাক্ট পেয়েছে। তিনি আজকাল একটু প্রাউড হয়েছেন... যাক, টাকা বেশি পেলে সকলেরই ওরকম হয়।’ আবার আর একটি চিঠিতে তারিফও করছেন: ‘‘ ‘ত্রিযামা’ বইতে আপনাদের চিরপরিচিতা ‘সুচিত্রা’ এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।’’ মাধবী মুখোপাধ্যায়, যাঁর অভিনয় বাংলা ছবিকে আন্তর্জাতিক শিল্পমানে পৌঁছে দিয়েছে, সুচিত্রাকে নিয়ে তাঁর খেদ ‘বাংলা সিনেমায় অসাধারণ কিছু রোল করে যাওয়া সত্ত্বেও ভদ্রমহিলা তেমন কোনও স্বীকৃতি পেলেন না।... ভাবলে অবাক লাগে, এইরকম একজন অভিনেত্রী কখনও জাতীয় পুরস্কার পাননি!’ নৈর্ব্যক্তিক এই মুগ্ধতার পাশেই আবার তাঁর ব্যক্তিগত বিনীত অনুযোগ, সুচিত্রার মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে: ‘আমার বাড়িতে হঠাৎ নেমন্তন্নের চিঠি এসেছিল। আমাদের, বাঙালিদের রীতি অনুযায়ী, মিসেস সেন বা ওঁদের পরিবারের কেউ সশরীরে নেমন্তন্ন করতে আসেননি। তাই আমার অভিমান হয়েছিল।’

আবহাওয়ার মতোই সকলের কাছে নিজেকে অনিশ্চিত অবোধ্য পূর্বাভাষ-রহিত করে তোলা, সুচিত্রার এই নক্ষত্রসুলভ স্বভাবটি সম্পর্কে পৌলমী সেনগুপ্ত লিখেছেন বইটির শুরুতেই, ‘কল্পনার কাছে যেখানে সত্য ও যুক্তি হার মেনেছে, তিনি সেখানেই রয়ে গেলেন।... কারণ বাঙালির কাছে তিনি তো শুধু সত্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন কল্পনা ও সত্যের সঠিক মেলবন্ধন। বঙ্গহৃদয়ের স্বপ্ন হিসেবে তাঁর স্থান আর কেউ নিতে পারবে না।’

স্বজন-আত্মীয়দের প্রতি অতি সহৃদয় সুচিত্রার ব্যক্তিগত জীবনের হরেক রকমের সঙ্গে তাঁর তারকা-জীবন, আত্মনির্বাসন, রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের কাছে নিঃসঙ্গ দীক্ষা, সব মিলেমিশে সাদাকালোয় ছাপা বইটি রীতিমতো রঙিন। গুলজারের মতো পরিচালক থেকে মাধুরী দীক্ষিত রানি মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীদের কলমে তাঁর সম্পর্কে মুগ্ধলেখ। দুর্লভ সব স্থিরচিত্রে আদ্যোপান্ত সাজানো বইটি। তাতে উত্তমকুমারের সঙ্গে তো অজস্র, এমন ছবিও আছে যেখানে তিনি গাল টিপে আদর করছেন সঞ্জীবকুমারকে; এমনকী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও— সুচিত্রার শেষ ছবির নায়ক। যাঁর মতে, ‘সুচিত্রা সম্পর্কে আজ যে-কথাটা বলতেই হয়, মুখশ্রী সম্পর্কে খুব সচেতন ছিলেন উনি। অসম্ভব ফোটোজেনিক ছিলেন। আর নিজে সেটা জানতেন বলে সেভাবেই ক্যামেরার সঙ্গে বোঝাপড়া করতেন। প্রায় প্রতিটি অ্যাঙ্গেলেই তাঁকে অসামান্য সুন্দর দেখাত।’

নামকরণটি যথার্থ বইটির: সম্পূর্ণ সুচিত্রা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন