সুপ্রিম কোর্ট কেমন রায় দিবে, তাহা বলিয়া দেওয়ার স্পর্ধাও অমিত শাহের দৃশ্যত আছে। যে রায় প্রয়োগ করা সম্ভব, আদালতের তেমন রায়ই দেওয়া উচিত, উচ্চারিত এই কথাটির গভীরে নিহিত আছে কিছু না বলা বাণী— শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত রায়টি দেওয়া আদালতের উচিত হয় নাই। এই স্পর্ধা কেন আদালত অবমাননা হিসাবে গণ্য হইবে না, সেই প্রশ্নটি উঠিবেই। কিন্তু, এই মুহূর্তে জরুরিতর প্রশ্ন, এ হেন স্পর্ধা আসে কী ভাবে? সেই উত্তরও বিজেপির সাড়ে চার বৎসরের শাসনকালেই রহিয়াছে। কেহ বলিতে পারেন, যে কোনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে অবজ্ঞা করিবার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অসম্মান করিবার অভ্যাসটি এত দিনে এমনই মজ্জাগত যে এখন আর সুপ্রিম কোর্টকে রেয়াত করিবার কথাও বিজেপি সভাপতির স্মরণে থাকে না। তাঁহারা বুঝিয়া লইয়াছেন যে এই ভারতে তাঁহাদের ইচ্ছাই নিয়ম, তাঁহাদের পথই আইন। কেরলের রাজ্য সরকার আদালতের নির্দেশ মান্য করিবার ‘ধৃষ্টতা’ দেখাইলে সরকার ফেলিয়া দেওয়ার হুমকিও দিয়া রাখিয়াছেন শাহ। এক্ষণে প্রশ্ন, দেশের প্রধান শাসক দলের সভাপতি যদি প্রকাশ্য জনসভায় সুপ্রিম কোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানান, গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সরকার ফেলিয়া দেওয়ার হুমকি দেন, তবে কী করণীয়? রাজনৈতিক ভাবে তিনি যতই ক্ষমতাবান হউন, তিনিও যে ভারতীয় গণতন্ত্র অপেক্ষা বড় নহেন, এই কথাটি তাঁহাকে বুঝাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করিবে কে?
এই স্পর্ধাটিকে সরাইয়া রাখিলে পড়িয়া থাকে একটি অবস্থান: সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যাহাকে ‘ন্যায্য’ বলিয়া বিবেচনা করেন, একমাত্র তাহাই ন্যায্য। বিচারবিভাগ হউক বা আইনবিভাগ, গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলির একমাত্র কর্তব্য সেই সংখ্যাগরিষ্ঠের বিবেচনাকে মান্যতা দেওয়া, প্রতিষ্ঠা করা। অমিত শাহের এই অবস্থানের মধ্যে এক অতলস্পর্শী ভ্রান্তি রহিয়াছে। গণতন্ত্রকে না-বুঝিবার, ভুল-বুঝিবার ভ্রান্তি। সরকার অবশ্যই জনগণের রায়ে নির্বাচিত, কিন্তু তাহার কাজ জনতাকে অনুসরণ করা নহে, বরং জনতার নিকট অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করা। তিনিই নেতা, যিনি জনতাকে ক্ষুদ্রতা হইতে বৃহত্ত্বে লইয়া যাইতে পারেন। জওহরলাল নেহরু যে অর্থে নেতা ছিলেন। এবং, নরেন্দ্র মোদী যে অর্থে নেতা নহেন। অমিত শাহদের মানসজগতে নেতৃত্বের এই রূপটির কোনও ছবি নাই। সংখ্যাগরিষ্ঠের মত যত ক্ষণ অবধি তাঁহাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের সমানুবর্তী, তত ক্ষণ অবধি তাঁহারা জনতাকে অনুসরণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী।
অমিত শাহ যে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাহাত্ম্য বুঝিবেন না, তাহা অতএব স্বাভাবিক। শবরীমালার রায়েই হউক বা ৩৭৭ ধারা সংক্রান্ত মামলার রায়ে, সুপ্রিম কোর্ট নৈতিকতার সংজ্ঞা বিষয়ে একটি স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করিয়া জানাইয়াছে, সামাজিক নৈতিকতা ও সাংবিধানিক নৈতিকতার মধ্যে কতখানি ফারাক, এবং জানাইয়াছে, দ্বিতীয়টিই আদালতের বিচার্য। কথাটির গুরুত্ব বাড়াইয়া বলা অসম্ভব। সমাজ, অথবা তাহার সিংহভাগ কোনও ব্যবস্থাকে নৈতিক বা অনৈতিক জ্ঞান করিতেই পারে— শবরীমালায় নারীর প্রবেশাধিকারকে যেমন ভক্তদের একাংশ অনৈতিক জ্ঞান করিতেছে। সেই বিচার আদালতের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করিতে পারে না। সংবিধানমতে যাহা নৈতিক, আদালত তাহার পক্ষেই দাঁড়াইবে। সেই অবস্থান যদি সমাজের সিংহভাগের অবস্থানের বিপ্রতীপ হয়, তবুও আদালতের অবস্থানই মান্য। তাহার নিরিখেই সমাজকে নিজের নৈতিকতার ধারণা পাল্টাইয়া লইতে হইবে। তাহাতে সাহায্য করাই নেতাদের কাজ। সঙ্কীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে অমিত শাহ বিপরীত সাধনায় রত। তিনি বুঝাইয়া দিতেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতা হওয়ার যোগ্যতা তিনি এখনও অর্জন করিতে পারেন নাই। বোধ করি, চাহেনও না।