শিক্ষাবৈষম্য

পাশ-ফেলের সহিত পড়ুয়াদের মেধার সংযোগ কতটা, সে প্রশ্নও তুলিয়া দেয় মাধ্যমিকের ফল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৯ ০০:৪৩
Share:

প্রতীকী ছবি।

অমর্ত্য সেন কেন ভারতকে বলিয়াছিলেন, ‘‘ফার্স্ট বয়দের দেশ’’, তাহা বুঝাইয়া দেয় মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল। কে প্রথম হইল, দিনে কত ঘণ্টা সে পড়িয়াছিল, তাহার আলোচনায় গোটা রাজ্য মাতিয়া ওঠে। এই বৎসর মাধ্যমিকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর অন্য সকল বৎসরকে ছাড়াইয়াছে, তাই শোরগোল কিঞ্চিৎ অধিক। এই হর্ষধ্বনিকে ‘বলির বাদ্য’ বলিলে ভুল হয় না। সমাজ এমন করিয়াই অবহেলা ও বঞ্চনাকে ঢাকিতে চায়। কিন্তু তাহার আয়তন এমনই বিপুল যে গোপন করা অসাধ্য। পাঁচ বৎসর পূর্বে এই রাজ্যে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়িত ষোলো লক্ষেরও অধিক ছাত্রছাত্রী। এই বৎসর তাহাদের সাড়ে দশ লক্ষ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসিয়াছে। পাঁচ বৎসরের মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর স্কুলছুট হইবার এই চিত্রটি গত সাত বৎসরে তেমন বদলায় নাই। বস্তুত ২০১৬ সাল হইতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত কমিয়াছে, গত বৎসরের চাইতে এই বারে কমিয়াছে ত্রিশ হাজার ছাত্রছাত্রী। বিবিধ সরকারি প্রকল্প সত্ত্বেও এই রাজ্য কেন তাহার শিশুদের স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণ করিবার সুযোগ করিয়া দিতে ব্যর্থ হইতেছে, আজ অবধি শিক্ষামন্ত্রী তাহার উত্তর দেন নাই। তাঁহার বড়ই সুবিধা। ব্যর্থতার লজ্জা পড়ুয়া এবং তাহার বাপ-মাকে এমনই সঙ্কুচিত করিয়া রাখে, যে তাঁহারা শিক্ষাব্যবস্থার গলদ লইয়া প্রশ্ন তুলিতে পারেন না। শিক্ষকেরা নিশ্চিন্ত যে, ছাত্রদের ব্যর্থতার জন্য তাঁহাদের কৈফিয়ত কেহ দাবি করিবে না। করিলেও অষ্টম শ্রেণি অবধি পাশ-ফেল উঠিয়া যাইবার অপকারিতা বুঝাইয়া তাঁহারা সহজেই নিষ্কৃতি পাইবেন।

Advertisement

অথচ পাশ-ফেলের সহিত পড়ুয়াদের মেধার সংযোগ কতটা, সে প্রশ্নও তুলিয়া দেয় মাধ্যমিকের ফল। পাশের হারে কয়েকটি জেলা প্রতি বৎসরই আগাইয়া থাকে, কয়েকটি থাকিয়া যায় পশ্চাতে। কোন জেলার ছাত্র প্রথম হইবে, তাহা অনিশ্চিত। কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর পাশের হারে শীর্ষে থাকিবে, তাহার নড়চড় নাই। অপর পক্ষে, উত্তর দিনাজপুর থাকিবে সর্বনিম্নে। তবে কি পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, কলিকাতা, হুগলিতে শিশুরা উচ্চমেধা লইয়াই ভূমিষ্ঠ হইতেছে? জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, উত্তর দিনাজপুর, মালদহে প্রতি প্রজন্মে মন্দ মেধার পড়ুয়ারা স্কুলে ভর্তি হইতেছে? উত্তর কাহারও অজানা নাই। উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় সরকারি স্কুলগুলি অবহেলিত বলিয়াই ছাত্রছাত্রীরা ব্যর্থ। রহস্য কেবল এই যে, বৎসরের পর বৎসর সেই ফল ঘোষণা করিতেছে সরকার, কিন্তু এই জেলাগুলিতে শিক্ষার মান উন্নত করিবার কোনও চেষ্টাই করে নাই। যেন উত্তর দিনাজপুরের পরীক্ষার্থীদের ফেল করিবার ঝুঁকি অধিক থাকাই স্বাভাবিক, ইহাতে সরকারের করণীয় কিছুই নাই।

মাধ্যমিকের ফলের প্রকৃত বার্তা বুঝিতে তাই অনুন্নত জেলার মন্দ ফলও যত্নের সহিত নিরীক্ষণ করিতে হইবে। উত্তর দিনাজপুরে অকৃতকার্য হইয়াছে তেরো শতাংশ ছেলে, কিন্তু তেত্রিশ শতাংশ মেয়ে। বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়াতে মেয়েদের ফেল করিবার হার ছেলেদের দ্বিগুণ। দলিত-আদিবাসী মেয়েদের ক্ষেত্রে তাহা অধিক। স্কুলশিক্ষা সব শিশুকে সমান সুযোগ দিয়া সমাজে সাম্য আনিবে, এমনই প্রত্যাশিত। কিন্তু শিক্ষার মানে তারতম্য থাকার ফলে জাতি-জনজাতি-লিঙ্গ ভেদে সামাজিক বৈষম্য গভীরতর হইতেছে। এ রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী মাধ্যমিকের ফল হইতে শিক্ষা লইবেন কবে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement