কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতীন গডকড়ীর মেয়ের বিয়ে ছিল কয়েক দিন আগে। দিল্লিতে প্রায় প্রতি দিন সন্ধ্যাতেই আসর। নৈশভোজ। অতিথি আপ্যায়ন। নাগপুরে মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, দিল্লিতে চলছে রিশেপশন। প্রতি দিন বদলে যাচ্ছে সবুজ লনের শামিয়ানা-সজ্জা। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে ‘ড্রোন’। এই যন্ত্রটিই নাকি আজকাল স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ছবি তুলছে সকলের। মঞ্চে সস্ত্রীক নীতীন। ওঁদের মেয়ে-জামাইকে আশীর্বাদ করতে লম্বা লাইন। সেই লাইন গুটিগুটি পায়ে এগোচ্ছে। যা দেখে পঞ্জাবি এক বিজেপি নেতা বললেন, ‘‘আমরা পঞ্জাবিরা হলাম যথেষ্ট লাউড। এখন তো দেখছি মুম্বইয়ের মরাঠিরাও কম যান না।’’
পাঠক ওই ড্রোন ক্যামেরার মতোই আমাকে দেখছেন। এই দেখুন, আমার ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিশিষ্ট এক শিল্পপতি এবং তাঁর স্ত্রী। ওঁরা লাইন টপকে মঞ্চে উঠে নব দম্পতিকে আশীর্বাদ জানাতে যাননি। কিন্তু, কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা তো এমনটাই করছিলেন। ওই তো এক জন পদ্মভূষণ-সাংবাদিককেও দেখছি। এটাই কি রাজধানীর পাওয়ার সার্কিট। আমিও কি এই সার্কিটের কুশীলবদের অন্যতম?
আমার মতো সমস্ত হরিদাস পালেরাই এই দিল্লিতে ভাবেন তারাই দেশ চালাচ্ছেন। এক জন সাংবাদিক, তাঁর বয়স হয়তো মেরেকেটে পঞ্চাশ হবে। তিনি তো প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার কাঁধে হাত দিয়ে বলছিলেন, ‘‘লুক। রবিশঙ্কর। ইউ ক্যান নট সে দিস।’’ টেলিভিশনে কী বলা উচিত নয়, সে সব ব্যাপারে সাংবাদিকটি সবিস্তার জ্ঞান দিচ্ছিলেন। আমি যখন প্রথম সাংবাদিকতায় ঢুকি, তখন আমার রাত করে বাড়ি ফেরায় বাবা খুব বিরক্ত হতেন। বলতেন, ‘‘কী চাকরি যে করিস! বাড়ি ফিরিস পাড়ার কিছু মাতাল আর নেড়িকুত্তার সঙ্গে।’’ সাংবাদিকতা সম্পর্কে তো আমার তখন কোনও ধারণাই ছিল না। সেই সময়ে, সাংবাদিকতার একদম প্রথম লগ্নেই এক সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন, ‘‘ভিখারিকে চার আনা পয়সা দিও। তাতে সেই গরিব মানুষটির কিছুটা হলেও সাহায্য হবে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী কে আক্কেল দিতে যেও না।’’ কিন্তু সব্বাই জ্ঞান দেয়। আর সেই সব স্বঘোষিত উপদেষ্টাদের এ সমাজে কদরও আছে। সার্কুলেশনে থাকতে গেলে হাব-ভাব ঠাটটাও রাখতে হয়।
খ্যাতি-যশ-অহঙ্কার— এ সবই তো অস্থায়ী। সেই কত কত যুগ আগে সক্রেটিস বলেছিলেন, জনপ্রিয়তা আর যশস্বী হওয়াও এক নয়। যত যত জানবে তত ততই তুমি যশপ্রার্থী হবে না। উত্তমকুমার যে দিন মারা গেলেন, সম্ভবত তার আগের দিন মারা গিয়েছিলেন সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ। বিনয়বাবুর মৃত্যুর সংবাদ খুব কম লোকেরই চোখে পড়েছিল। তা বলে কি তিনি নগণ্য লোক? পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর গবেষণা আজও যে কোনও জিজ্ঞাসু ছাত্রের বিশেষ অ্যাপেটাইজার। বিনয়বাবু কালোপেঁচা ছদ্ম নামে এক পাগলের গলা শুনিয়েছিলেন। রাস্তার ছেলেরা রোজ ওই পাগলটাকে ঢিল ছুঁড়ে মারত। তা এক দিন ওই পাগলটি রেগে গিয়ে পাড়ার ওই যুবকদের বলেছিল, তোরা আমায় এমন ঢিল ছুড়িস কেন? তোরা পাগল নাকি?
কে যে পাগল আর কে যে আসল বোঝা দায়! অপর্ণা সেনের ‘পার্ক অ্যাভিনিউ’ ছবির শেষ দৃশ্য। কঙ্কনা সেনশর্মা গাড়ি থেকে নেমে দেখছেন এক কল্পনার জগৎ, যেখানে তাঁর সন্তান খেলা করছে। তিনি দেখছেন তাঁর স্বামী তথা পরিবারকে। কে সত্য? কে মিথ্যা? কোনটা সত্য? কোনটা মিথ্যা? কঙ্কনা যা দেখছিলেন, ভাবছিলেন সেটাই সত্য? আর আমরা দর্শকরা সিনেপ্লেকস পর্দার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, কঙ্কনা পাগল। তাই ভুল দেখছে। আমরা সুস্থ তাই সত্যকে দেখছি! এটাই কি আত্মপ্রবঞ্চনা ‘নাথিং ইস সো ডিফিকাল্ট? অ্যাস নট ডিসিভিং ইয়োরসেলফ’। আপনি আসলে কে? আপনি তাই যে ভাবে আপনি মানবসমাজে প্রতিভাত। আপনি কী তা গুরুত্বপূর্ণ নয় গুরুত্বপূর্ণ হল, হাউ আর ইউ পারসিভড়? আপনি সেলিব্রিটি ভিআইপি না সাধারণ মানুষ?
নোটবদল পর্ব চলছে এখন ভারতীয় রাজনীতিতে। সংবাদ মাধ্যমের আখ্যান। তোলপাড় এ দেশ। রাজপথে-জনপথে মানুষের লম্বা লম্বা লাইন। শত শত হাজার হাজার এটিএমের সামনে। এ হেন ক্লেশ সবই যেন সাধারণ মানুষের। কোনও মন্ত্রীর মেয়ের বিবাহ অনুষ্ঠানই হোক আর কোনও রাজনৈতিক নেতার দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচাই হোক— কোথাও তো কোনও সমস্যাই দেখছি না। কী ভাবে সম্ভব হয়? নতুন নোটের কোটি কোটি টাকার পাহাড় এর মধ্যেই জমা হয় কোনও কোনও মানুষের ফ্ল্যাটে। আর লাইনে দাঁড়িয়ে জনঅরণ্য। হে মোর দুর্ভাগা দেশ!