গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
এই মাসের গোড়ায় অহমদাবাদের বিধ্বংসী বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হল এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট সুমিত সবরওয়ালের এবং তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর অল্প কদিনের মধ্যেই কিছু কিছু মিডিয়ায় একটা অতি পরিচিত ও অস্বস্তিকর তত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ল। সরকারি তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই মিডিয়ার বিভিন্ন ‘গোপন সূত্র’ এবং নানা শিরোনামের মাধ্যমে আমাদের আকারে-ইঙ্গিত জানিয়ে দেওয়া হল, পাইলটের সম্ভবত কোনও ‘মানসিক অসুস্থতা’ ছিল। ফলে পুরো বিষয়টাই মসৃণ ভাবে ঘুরে গেল অন্যদিকে। এই দুর্ঘটনার পিছনে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি আছে কিনা, তার চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠল ব্যক্তিবিশেষের অসুখ এবং ভারসাম্যহীনতা।
এটা কেবলমাত্র দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে গুজব ছড়ানো নয়, এর পেছনে আসলে কাজ করেছে রাজনীতি। মৃত মানুষটার ওপর দায় চাপিয়ে দাও। তাঁকে ‘মানসিক রোগী’ প্রতিপন্ন কর। কারণ, তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনও কথা বলতে পারবেন না। আর তার ফলে ক্ষমতার চূড়ায় বসে থাকা প্রকৃত দোষীদের উপর থেকে প্রশ্নের অভিমুখটাও ঘুরে যাবে।
তবে এটা কিন্তু কেবলমাত্র ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভাসিয়ে দেওয়া কোনও ধারণা নয়। ‘বোয়িং’-এর মতো আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা আর ওয়াশিংটন পোস্টের মতো নামজাদা সংবাদমাধ্যমও সুচারু ভাবে এই তত্ত্বকে পুষ্টি জুগিয়েছে। ফলে একটা আন্তর্জাতিক ‘ইকো-চেম্বার’ তৈরি হয়েছে। যে-যে সমস্যা আসলে কর্মক্ষেত্রের ভয়াবহ পরিস্থিতি, নানা নিয়ন্ত্রণজনিত ত্রুটি বা কর্পোরেটের নানা গাফিলতির ফলাফল, এই ইকো-চেম্বারে সেগুলোর শুদ্ধিকরণ ঘটছে। সরলীকরণ ঘটছে। সমস্ত সমস্যার একটাই ব্যাখ্যা শোনা যাচ্ছে― মানসিক অসুস্থতা!
একটা কথা এখানে স্পষ্ট ভাবে বুঝে নেওয়া উচিত, এটা কিন্তু কোনও ভাবেই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয় নয়। এখানে মনোরোগ-বিজ্ঞান আদপে নানা প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটিকে সমাজ-মানস থেকে মুছে ফেলার হাতিয়ার মাত্র।
এর আগেও আমরা একই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেছি। ২০১৫ সালে জার্মান উইংস বিমান দুর্ঘটনার পরে বিভিন্ন কাগজের শিরোনাম ভরে উঠেছিল পাইলট আন্দ্রেয়াস লুবিট্জ-এর ‘মানসিক অসুস্থতা’-র ইতিহাসে। তার পর পরই নতুন নতুন নজরদারি ব্যবস্থা চালু হল। আর তার ফলে যে সমস্ত পাইলট মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নিয়েছেন, সমস্ত সন্দেহটাই গিয়ে পড়ল তাঁদের উপর। অথচ বিমানশিল্পে কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূল পরিবেশ নিয়ে একটা প্রশ্নও উঠল না। উল্টে একটা ভয়ঙ্কর বার্তাকেই যেন প্রতিষ্ঠা করে দেওয়া হল— যাঁরা মানসিক প্রতিবন্ধকতার ভুক্তভোগী, তাঁরা ভারসাম্যহীন। আনপ্রেডিক্টেবল। বিপজ্জনক।
সেই একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখছি ভারতে।
জানা যাচ্ছে, সুমিত সবরওয়াল বিগত ২৭ দিনে ৫৯ ঘন্টা বিমান চালিয়েছিলেন। এই একটা তথ্যের ভিত্তিতেই কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়ার ‘রস্টারিং’ পদ্ধতি, কমার্শিয়াল পাইলটদের অমানুষিক কাজের চাপ, বিমানশিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা কর্মীদের ক্ৰমবর্ধমান ক্লান্তি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠতে পারে। অথচ, এই কড়া প্রশ্নগুলো তোলার বদলে, মৃত সুমিতের আপাত ‘মানসিক স্বাস্থ্য-বিপর্যয়ের’ দিকেই সমস্ত মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর এই তত্ত্বের ভিত্তি শুধু কয়েকটা বেনামি সূত্র। কোনও ‘মেডিক্যাল কনফার্মেশন’-ও নেই। মনোচিকিৎসকের কোনও রিপোর্ট জনসমক্ষে পেশ করা হয়নি। কিসের ভিত্তিতে আমরা এই রোগ নির্ণয় করলাম? ব্ল্যাক বক্সের তথ্য অনুযায়ী, যেখানে তাঁর কণ্ঠস্বরে আতঙ্কের লেশমাত্র ছিল না? বা আমরা তা খুঁজে পাইনি? আমরা জানি, যখন কোনও বিপর্যয় আসে, তখন তাকে শান্ত ভাবে মোকাবিলা করার প্রক্রিয়াকেই গৌরবান্বিত করা হয়। চলচ্চিত্র, মিডিয়া ও সাহিত্যে তার অসংখ্য উদাহরণ দেখি। তা হলে সেই শীতলতা বা নিয়ন্ত্রণকেই কেন আজ আমরা রোগের লক্ষণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছি? সরকারি ভাবে এ বিষয়ে কোনও তদন্তও এমন কোনও সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেয়নি। অথচ ‘ডায়াগনোসিস’ বা রোগনির্ণয় ইতিমধ্যেই চিহ্ণিত ও জনসমক্ষে বর্তমান। যা আদ্যোপান্ত অস্পষ্ট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অতি অবশ্যই বিপজ্জনক।
এই যুক্তির কাঠামো মূলত তিনটি উদ্দেশ্য সাধন করে―
১. যে সংস্থার বিমানটি দুর্ঘটনাগ্রস্ত, সেই এয়ার ইন্ডিয়া, ডিজিসিএ এবং বোয়িং কর্তৃপক্ষকে শ্রম-আইন লঙ্ঘন, নিরাপত্তার কাঠামো সংক্রান্ত নানা কঠিন প্রশ্ন থেকে আড়াল করা।
২. ব্যবস্থাগত, কাঠামোগত নানা বিচ্যুতির উপর থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে বিশেষ কোনও ব্যক্তির ব্যর্থতাকে বড় করে তোলা।
৩. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নানা বিপজ্জনক ধারণা চাপিয়ে দেওয়া। যা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যাবতীয় আন্দোলন, চর্চা ও লড়াইকে আরও পিছনের সারিতে ঠেলে দেবে।
এটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা, এমন ভান করে কোনও লাভ নেই। এই ঘটনা আসলে পরিকল্পিত। অথচ, ‘পাবলিক রিলেশন মেশিনারি’ অতি সাবধানে প্রথম ভাষ্যটা তৈরি করেছে। আর তা ছড়িয়ে দিচ্ছে অনুগত মিডিয়াকুল। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা পেশাজীবীর নীরবতা তাকে ক্রমে স্বাভাবিক করে তুলছে।
মানসিক স্বাস্থ্য-পেশাজীবীরা এই মুহূর্তে কোথায়? এই ঘটনায় মানসিক স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গটি যে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে তুলে আনা হল, তা নিয়ে ভারতের প্রথম সারির মানসিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোর তরফে কোনও বিবৃতি বা প্রতিবাদ এল না কেন? একজন মৃত ব্যক্তিকে কোনও প্রমাণ, সম্মতি, বা প্রেক্ষিত ছাড়াই ‘মানসিক রোগী’র তকমা দিয়ে দেওয়াটা অত্যন্ত অনৈতিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ নিয়ে কেউ কেন সামান্য প্রতিবাদটুকুও করলেন না?
মানসিক অসুস্থতা কোনও প্রতিষ্ঠানের ভুলত্রুটি ঝেড়ে ফেলার অস্ত্র নয়। মানসিক অসুস্থতা কর্পোরেটের দায় আড়াল করারও অজুহাত হতে পারে না। প্রভাবশালীদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একজন মৃত ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এমন মনগড়া কথাও হাওয়া-বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না।
‘ওয়ার্ল্ড সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘মাদ্রিদ ঘোষণাপত্রে’ স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, কোনও রাজনৈতিক বা আইনি স্বার্থের জন্য মনোরোগবিদ্যার অপব্যবহার করা যাবে না। অথচ এই নিষেধাজ্ঞা বারবার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কেবল ভারতীয় সংস্থাগুলিই নয়, ‘বোয়িং’-এর মতো বহুজাতিক সংস্থা আর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও এতে জড়িত। বিমানশিল্পের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এরাই এমন একটা তত্ত্ব প্রচার করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
এটাই মানসিক স্বাস্থ্য-পেশাজীবীদের জেগে ওঠার আদর্শ সময়। আমরা কি মানুষকে সুস্থ করতে চাই? নাকি আমরা ক্ষমতার দাস? আমাদের মূল লক্ষ্য কি মানুষের সেবা? নাকি বিভিন্ন প্ৰাতিষ্ঠানিক অপরাধ নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করা? আমরা কি ন্যায়ের পক্ষে? নাকি একজন ব্যক্তির ওপর এ ভাবে ‘মনোরোগী’ তকমা চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে?
এটা শুধু ক্যাপ্টেন সুমিত সবরওয়ালের বিষয় নয়। যে সমস্ত মানুষ মনোসামাজিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছেন, তাঁদের সকলের বিষয়। যাঁরা সভয়ে দেখছেন, আবারও মানসিক অসুস্থতা নামক বাস্তবতার সঙ্গে ঝুঁকি, বিপদ আর ব্যর্থতার নানা অনুষঙ্গ জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। যে-সমস্ত পাইলট, নার্স, ডাক্তার বা কর্মী জীবিতাবস্থায় পেশাজগতে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার ভয়ে বা মৃত্যুর পরে সম্মানহানির ভয়ে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এড়াচ্ছেন, এটা তাঁদেরও বিষয়।
এই সময়ে যদি গোটা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবি জানানো যেত!
বিমানশিল্প-সহ উচ্চ মানসিক চাপবহুল কর্মক্ষেত্রগুলিতে নজরদারিবিহীন, মানসিক-স্বাস্থ্য সচেতন পরিকাঠামো গড়ে তোলার দাবি। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে, বিশেষত মৃত ব্যক্তির মিডিয়া-রিপোর্টিং সম্পর্কে ‘গাইডলাইন’ চালু করার দাবি। বিশ্বজুড়ে দাবি জানানো উপযুক্ত প্রেক্ষিত, ব্যক্তির স্পষ্ট সম্মতি এবং ‘ক্লিনিক্যাল ভেরিফিকেশন’ ছাড়া জনসমকক্ষে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও মন্তব্য করা যাবে না।
যদি বিশ্বের সকল মানসিক-স্বাস্থ্য সংস্থাগুলি একসঙ্গে প্রতিবাদ জানাত! সকলে যদি একসুরে বলত― এহেন তত্ত্বের এখানেই ইতি।
আমরা ক্যাপ্টেন সুমিত সবরওয়ালের পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ। মনোসামাজিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করছেন যাঁরা, তাঁদের প্রতি দায়বদ্ধ। আমাদের পেশা, সততা, বিবেকের কাছেও আমরা দায়বদ্ধ। এই মুহূর্তে চুপ থাকা মানে এই ভয়ঙ্কর ব্যবস্থাকে মদত জোগানো। আমাদের স্পষ্ট বোঝা উচিত, সমস্যা ব্যক্তির নয়, সমস্যা ব্যবস্থার। আর এই সত্যিটাকে ঢাকার জন্য যদি মনোরোগবিদ্যার মুখোশ পরাতে হয়। তবে সত্যিই আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছি!
(লেখক মনোসমাজকর্মী। মতামত নিজস্ব)