Russia Ukraine War

এ বার মিছিলে হাঁটব না?

অন্য দেশের সমস্যা বলে মুখ ফিরিয়ে না থাকার আর একটা বড় কারণ হল বিশ্বায়ন— এই যুদ্ধ সবাইকেই অর্থনৈতিক ভাবে কম-বেশি ভোগাবে।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২২ ০৬:২৮
Share:

রাশিয়ার ইউক্রেন হামলায় আমাদের দেশের সিদ্ধান্ত হল নিরপেক্ষ থাকা। রাষ্ট্রপুঞ্জে তাই ভারত ভোটদানে বিরত। এটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ। তা ছাড়া, ভাবের ঘরে চুরি না করাই ভাল— অন্য দেশের রাজনীতিতে আমরা নাক গলাব না, আমাদের দেশের কোনও সিদ্ধান্তকে অন্য কেউ নিন্দা করুক, সেটাও চাইব না। তাই, আমরা ‘পাশ’ কাটাচ্ছি, এই তাস খেলায় ‘পাস’ দিচ্ছি। নানাবিধ যুক্তি সাজিয়ে সব দলের নেতারাই আজ চুপ। যুক্তি আরও আছে। আমরা, বাঙালিরা, ভারতীয়রা অনেকেই নিজের দেশের মধ্যে কাশ্মীরকে, কাশ্মীরিদের চিনি না, তাঁদের ইতিহাস-ভূগোল-ধর্মাচরণ বুঝি না, ইউক্রেন তো সত্যিই বহু দূর। অতএব, কিছু না জেনে-বুঝে এখানে মুখ খোলা নিজেদের ঘরের কাচের জানলায় ঢিল ছোড়ার শামিল।

Advertisement

ইউক্রেনের পূর্বের বিস্তৃত এলাকায় অনেকেই ইউক্রেনে থেকেও নিজেদের হয় রাশিয়ার অংশ, নতুবা স্বাধীন মনে করেন। জিরাফ একা নয়, সেখানে ধর্মও আছে। পুতিনের ‘নিয়ো-নাৎসি’ অজুহাতটা ঠিক বলুন বা ভুল, মানতেই হবে, ইহুদিদের সমস্যাটাও এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ।

তবু, মনে হতে পারে, বাঙালি প্রতিবাদ মিছিল করতেও যেন ভুলে গিয়েছে। ইউক্রেনে বোমা-পড়ার মতোই আকস্মিক আমাদের এই অসহায়বোধের নানাবিধ কারণ আছে। প্রথম কথাই হল, কাজটা করছে রাশিয়া। জন্ম থেকে শুনছি, ভারত রাশিয়ারই ছত্রছায়ায়, আর আমাদের চিরশত্রু প্রতিবেশী দেশটা আমেরিকার— এটাই নাকি ঠান্ডা যুদ্ধের দস্তুর, আমরা সেই দাবাখেলায় বোড়ে মাত্র। রাশিয়া যেন এক যৌথ পরিবারের মাথার উপরের রাগী বড়দা, যিনি ভুল করলেও তাঁর কোনও সিদ্ধান্ত বা কাজকেই ভুল বলা যায় না। তা ছাড়া এত দিন আমেরিকার অনেক দাদাগিরির নমুনা তো আমরা দেখেছিই, গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে, প্রতিবাদ করিনি; এ বার নাহয় রাশিয়ার পালা— মেনে নেওয়াই যাক না।

Advertisement

রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের সম্পর্ক দীর্ঘ। একাত্তরের যুদ্ধসহায়তা শুধু নয়, আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি জুড়ে আছে রাশিয়া থেকে আসা শিশুসাহিত্যের সম্ভার, ছবিতে ভরা মোটা মোটা সব বই। আশির দশকে কলেজে পরিসংখ্যান-বিজ্ঞানের সঙ্গে ফাউ হিসেবে রাশিয়ান ভাষাশিক্ষা, তার পর গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রইকা পেরিয়ে সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাও আমাদের প্রজন্মেরই।

আবার, উল্টো দিকে পুতিনের ‘যুদ্ধ’ তো ঠিক ইউক্রেনের বিরুদ্ধে নয়, নেটো-র বিরুদ্ধে। কে না জানে, নেটো মানেই বিলেত-আমেরিকা; আর, সেটা তো আজকাল ‘দেশি’-দেরই দেশ। উপনিবেশের গল্প আজ উল্টে গিয়েছে— আমেরিকার কমলা হ্যারিস, বিলেতের ঋষি সুনক, প্রীতি পটেল আমাদেরই ঘরের লোক।

তবে, তৃতীয় কারণটাই সবচেয়ে ভোগাচ্ছে এখন। ছোটবেলা থেকেই দেখছি পাঁচিলে লেখা ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’; তখন বুঝেছি, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী’রাই নাকি শুধু যুদ্ধ চায়, তাই, ‘নিপাত যাক ফ্যাসিবাদ’। দেওয়াল-লিখনগুলোর মানে দাঁড়াত— হয় তুমি মুনাফালোভী অথবা যুদ্ধবিরোধী; শান্তি আর সাম্য সে দিন ছিল সমার্থক। চৌত্রিশ বছর ধরে এই মত বিশ্বাস করে আমরা বড় হয়েছি; এখন অবশ্য আমরা বাজারি অর্থনীতির সেবক। তবে, প্রতিবাদ করতে সমাজবাদী বা বামপন্থী হওয়া তো আবশ্যিক নয়; পোড়খাওয়া ব্যবসায়ীও শান্তি এবং সাম্য দুটোই চাইতে পারেন।

তবু, ‘যুদ্ধ চাই না’ স্লোগান তোলার কাজটা এখনও আমরা বাম দলের নেতাদের কাছেই আশা করি। আগে তো ভিয়েতনাম, ম্যান্ডেলা, তিয়েনআনমেন স্কোয়ার নিয়ে তো আমরা কত বার মিছিলে হেঁটেছি, ব্রিগেডে জময়েত হয়েছি। সেই সব দেশের সমস্যাগুলো কি সত্যি আমরা ঠিক জানতাম বা বুঝতাম? প্রতিবাদ হত তো!

অবশ্য সাম্প্রতিক অনেক দেশের ক্ষেত্রেই আমাদের কোনও হেলদোল ঘটেনি। ইউক্রেনের পাশের বসনিয়া বা নিজেদের ঘরের এত কাছের রোহিঙ্গাদের হয়ে মুখ খুলিনি; ইরাক, আফগানিস্তানও আমাদের কর্মসূচিভুক্ত হয়নি।

যুদ্ধ বা আগ্রাসন কোনওটাই সমর্থন করা চলে না। তবু, আজ ২০ লক্ষ সাধারণ মানুষ বাস্তুহারা হলে তার প্রতিবাদ করার জন্য কান্ডারি চাই কেন? বর্ডার পেরোনোর যাতনা, এই আশীবিষের দংশন যে কী, তা আর যাকেই হোক, বাঙালিকে নিশ্চয়ই বোঝাতে হবে না!

দেশ হিসেবে কী করতে পারি? অন্তত, ইজ়রায়েলের মতো মধ্যস্থতা করতে পারি। ইহুদিদের জন্য যদি পুতিনের সত্যি এত দরদ থাকে, তা হলে আমেরিকার বন্ধু হয়েও, ইজ়রায়েল রাশিয়াকে সমঝোতা করতে বাধ্য করতে পারে। ভারতও কেন সেই চেষ্টা করবে না? আমাদের চাপে পড়ে, কথা শুনে, সাময়িক যুদ্ধবিরতি তো হতে পারে। জগৎসভায় আমরা শ্রেষ্ঠ আসন পাওয়ার আশা করব, অথচ গা বাঁচিয়ে কত দিন থাকব?

অন্য দেশের সমস্যা বলে মুখ ফিরিয়ে না থাকার আর একটা বড় কারণ হল বিশ্বায়ন— এই যুদ্ধ সবাইকেই অর্থনৈতিক ভাবে কম-বেশি ভোগাবে। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ দেখলেও কিন্তু আমাদের চেষ্টা করা উচিত এই যুদ্ধ বন্ধ করানোর। এই আগুন গোটা বিশ্বের অর্থনীতি, বাজারকেই পোড়াবে; ফোস্কা আমাদের চামড়ায় হয়তো বেশিই পড়বে, কে জানে।

অর্থনীতি বিভাগ, কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন