পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্রের মান নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। কারণ এত নিম্নমানের গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার চেহারাটাই ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে থেকে যাবে। এই বাস্তবটা নিশ্চয় সমাজ থেকেই উঠে এসেছে। একটা সমাজ কেমন, তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, সেটা রাস্তাঘাটে মানুষের আচরণে বোঝা যায়। কিংবা, সোশ্যাল মিডিয়াতে এক জন মানুষকে কতটা অপমান করা যায়, তার যে প্রতিযোগিতা চলছে সেটাও বলে দেয় সমাজটা কেমন। অথবা, ধরা যাক, যেখানে সেখানে যখন তখন যে কোনও উপলক্ষে সেলফি তোলা ও তা ছড়িয়ে দেওয়া। এই সমাজ যে রাজনীতির জন্ম দেয়, তার চেহারা-চরিত্রও তথৈবচ।
সেই চেহারা ও চরিত্রের নানান দিক। এখানে কেবল একটি দিক নিয়েই কিছু কাণ্ডজ্ঞানের কথা বলব। সেটা হল নির্লজ্জ ভোটার-তোষণ। কী ভাবে রাজস্ব বৃদ্ধি হবে, কোত্থেকে টাকা আসবে, সে সবের দিকে কোনও মনোযোগ না দিয়েই একের পর এক ঘোষণা শোনা গিয়েছে রাজনীতির কারবারিদের মুখে। কোনও কর বাড়বে না, কিন্তু অতিরিক্ত রোজগার হবেই— কথাটা আপাতদৃষ্টিতে সুস্থমস্তিষ্কের কথা হতে পারে না, কিন্তু যাঁরা এ কথা বলছেন তাঁরা অত্যন্ত চালাক, তাঁরা জানেন এ দেশে এখনও এ সব প্রতিশ্রুতি বিলিয়ে ভোট পাওয়া যায়। আর কোনও অজ্ঞাত কারণে বৌদ্ধিক পান্ডারা এতটাই বিরক্ত ও ভীতিগ্রস্ত যে তাঁরা, বিরোধী পক্ষের নতুন জনপ্রিয় প্রকল্পের টাকাটা কোত্থেকে আসবে কিংবা উত্তর ভারতে শাসক দল ভোটে মার খাওয়ার পর কৃষককুলের জন্য অতিরিক্ত রোজগারের ব্যবস্থা ঠিক কোত্থেকে হবে তা নিয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলতে চান না। কেউ কেউ সম্পদ কর বসানো, সারে ভর্তুকি বন্ধ করা এবং অমিতধনশালী বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কর ছাড় না দেওয়ার অলীক স্বপ্ন দেখেন, আজও। ঠিক ভোটের আগে তাঁরা ভুলে যান বিখ্যাত রাজনৈতিক দলগুলোর পিছনে ওই সম্পদশালী, বৃহৎ কৃষক এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের প্রচুর অর্থকরী সমর্থনের কথা। সেই তাঁদের ওপর বিপুল কর বসাবে ওই রাজনৈতিক দলগুলো? এ কি আজব দেশে অ্যালিসের গল্প? এক সময় ভাবা হত ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একশো দিনের কাজের প্রকল্পটি বিরাট খরচের ব্যাপার। সেটার জোগান দিতে নতুন কোনও বৈপ্লবিক কর নীতি গৃহীত হয়নি। আজও হবে না।
এ কথা বলতে বলতে এবং শুনতে শুনতে মানুষের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মানুষের উপায় নেই। মানুষের কাছে যা আছে, তা দিয়েই সিদ্ধান্ত নেন। এটা সত্যি, কিছু গরিব মানুষ এ সব প্রকল্পে উপকৃত হন। কিন্তু বৃহত্তর অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে তার মূল্যায়ন জরুরি নয় কি? আর তাই, ফাটা রেকর্ডের মতো শোনালেও, কিছু কথা বলতেই হয়। আর এক বার বলতে হয়, গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আসলে অন্যের রোজগারের ওপর নিজেদের ক্ষমতা কব্জা করার গল্প। এটা মনে রাখলে রাজনৈতিক মিথ্যাচারের স্বরূপ খানিকটা বোঝা যাবে।
যদি এ দেশে একশো দিনের কাজ, কৃষকদের জন্য বর্তমান সরকারের অতিরিক্ত আয় এবং বিরোধী পক্ষের প্রস্তাবিত দরিদ্রদের জন্য রোজগার, এই তিনটি প্রকল্প একসঙ্গে চালু থাকে, প্রতি বছর তার মোট খরচ ৫ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। এখন, বিভিন্ন সূত্র থেকে সরকারের যা আয়, সেই হিসেবটা মাথায় রাখলে দেখব, প্রতি টাকার ৫৩ পয়সা আসে পরোক্ষ কর থেকে, আর ১৭ পয়সা আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে। সরকার রাতারাতি এই বিভাজন পাল্টাতে পারবে না আর রাজনীতিকে মূলধন জোগান যাঁরা, সেই বিত্তশালীদের ওপর নতুন কর বসানোর অলীক স্বপ্নের কথা যদি ছেড়ে দিই, তা হলে ওই ৫ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে মোটামুটি ৩ লক্ষ কোটি টাকা অতিরিক্ত পরোক্ষ কর তুলে ব্যবস্থা করতে হবে। এই পরোক্ষ কর দেবেন গরিব বড়লোক মধ্যবিত্ত সবাই। যদি দেশের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে গড়ে চার জনের একটি পরিবার হয়, তা হলে প্রতি বছর প্রতি পরিবারকে দশ হাজার টাকার অতিরিক্ত কর দিতে হবে, জিনিসপত্র কেনার মাধ্যমে। প্রশ্ন হল, বিজেপি সরকার যদি বছরে ৬০০০ টাকা কৃষকদের দেন, তা হলে ১০০০০ টাকা অতিরিক্ত পরোক্ষ কর দিলে তাঁদের থাকবে কী? আবার, এক লক্ষ কোটির অতিরিক্ত প্রত্যক্ষ কর সরকারকে তুলতে হবে। প্রত্যক্ষ করের মধ্যে আয়করই মূল। তাই মোটা দাগের হিসেব, এক লক্ষ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয়করের প্রয়োজন হবে। তা হলে, কংগ্রেস যে ঘোষণা করেছে আয়কর আর বাড়বে না, কী হিসেবে সেটা বলছে?
আরও অনেক প্রশ্ন আছে। কংগ্রেস সরকারকৃত একশো দিনের কাজ প্রকল্প যদি সাফল্য পেয়েই থাকে, দরিদ্র সেবার অতিরিক্ত মহা-আয়োজনের এত প্রয়োজন কিসের? আর, বিজেপি সরকারের সময় দেশের আয়বৃদ্ধির হার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও কৃষক ভাতার প্রয়োজন হল কেন? সামগ্রিক ভাবে দেখলে, স্বাধীনতার সত্তর বছর বাদেও এ অবস্থা কেন? দায়ভার যাঁরা শাসন চালিয়েছেন তাঁদেরই, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আর একটা কথা। চারিদিকে ঢক্কানিনাদবহুল গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, গরিব মানুষদের হাতে টাকাপয়সা দিলে তাঁরা খুব বুদ্ধি করে খরচ করেন, বিনিয়োগ করেন, কর্মদক্ষ হন, ইত্যাদি। সব সময় এমনটা হয় কি না, সন্দেহ আছে। কিন্তু, যদি এই ফল ঠিক বলে মনে হয় তা হলে ঠিক উপদেশ হবে: সরকার সমস্ত বিশেষ প্রকল্প বন্ধ করে দিয়ে যা খরচ করছে সেটা ভাগবাটোয়ারা করে দিক। সমমূল্যের টাকা ব্যাঙ্কে গরিবদের আমানতে পাঠিয়ে দিক। ৬০০০ বা ১২০০০ কেন, অনেক বেশি পাবেন তাঁরা।
সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক