একেশ্বর, কিন্তু জনমুখী

স্বাধীনতার সত্তর বছর অতিবাহিত। গণতন্ত্র এখন আর নবীন নয়, বৃদ্ধ এ দেশে। কিন্তু জানেন, এই গণতন্ত্রে বড় ক্লান্তি এসেছে আজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের ক্লান্তি এসেছিল স্বৈরতন্ত্রে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share:

ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়িটা থামতেই এক অপরিচ্ছন্ন পোশাক পরিহিত দরিদ্র মহিলা দীর্ঘ লাঠিতে যুক্ত একটি বড় জাতীয় পতাকা হাতে বন্ধ জানলার কাঁচে ঠকঠক করছিলেন শীর্ণ মুঠি দিয়ে। পতাকা বিক্রি করে কিছু উপার্জন তাঁর লক্ষ্য।

Advertisement

স্বাধীনতার সত্তর বছর অতিবাহিত। গণতন্ত্র এখন আর নবীন নয়, বৃদ্ধ এ দেশে। কিন্তু জানেন, এই গণতন্ত্রে বড় ক্লান্তি এসেছে আজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের ক্লান্তি এসেছিল স্বৈরতন্ত্রে। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত তখন সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। সবাই চাইছিল গণতন্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন সবে শেষ হয়, তখন কেবলমাত্র ১২টি সার্বভৌম রাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত। এর পর দ্রুত এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। ’৭২ সালে ৪৪টি রাষ্ট্র গণতন্ত্র অর্জনের তালিকায় ছিল। ’৯৩ সালে সংখ্যাটি হয় ৭২। ১৯৫টি দেশের মধ্যে মোট ১১৭টি দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

আজ স্বাধীনতার সত্তর বছর পর গণতন্ত্রের অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর সেই গণতন্ত্রে ক্লান্তি এসেছে। এখন সমগ্র পৃথিবী জুড়ে গবেষণা চলছে, উদার গণতন্ত্রের যুগের বুঝি অবসান হল। পণ্ডিতরা অনেক নতুন নতুন পরিভাষা আনছেন, ডিলিবারালাইজেশন, ডিসিভিলাইজেশন, অনেকে বলছেন দ্য গ্রেট ডিপ্রেশনের মতো এখন এসেছে দ্য গ্রেট রিগ্রেশন-এর যুগ। এই যুগে গণতন্ত্রর পরীক্ষা যতই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হোক না কেন, দেখা যাচ্ছে, মানুষ সর্বত্র স্বৈরতন্ত্রী পপুলিস্ট এক নেতাকে খুঁজছে। অতীতে পপুলিজমকে বামপন্থার সঙ্গে যুক্ত করা হত। এখন তো পৃথিবী জুড়ে দক্ষিণপন্থী পপুলিজমও দেখা যাচ্ছে। এই পপুলিস্ট নেতা কেমন হবেন? তিনি রাগী হবেন। তাঁর ভোটাররা হবেন হতাশ, ক্ষুব্ধ। তাঁরা সাম্প্রদায়িক, এমনকী জাতিবিদ্বেষীও হতে পারেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রিস দেশে সিরিজা পার্টি বামপন্থী জোট গঠন করে ক্ষমতায় আসে, আবার স্পেনে আসেন পোদেমস। এরা ভেনেজুয়েলার উগো চাভেসের মতো বামপন্থী পপুলিস্ট। আবার আজ আমেরিকার ট্রাম্প বা তুরস্কের নেতা রিসেপ তায়িপ এরদোগান— এরা দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট। এরা একত্ববাদীও। আমিই জনগণ। গণতন্ত্রে বহুত্ববাদ প্রয়োজন, আজকের এই পপুলিজম বহুত্ববাদ-বিরোধী। তার প্রয়োজন সত্তার রাজনীতি। সে সত্তা সংকীর্ণ জাতিসত্তা, ভাষার সত্তা বা আঞ্চলিক সত্তা হতে পারে। এই পপুলিস্ট নেতা কখনওই বলেন না, আমি শতকরা ৯৯ ভাগ। তিনি বলেন আমিই ১০০ ভাগ।

Advertisement

আমরা আর্থিক-সামাজিক সংকটে থাকা মানুষ গণতন্ত্রের ললিতবাণী শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে আরও অনুদার হয়ে যাচ্ছি? তাই সেই পপুলার নেতাকে খুঁজছি? গণতন্ত্র অনেক জটিল ধারণা। পপুলিজম খুব সহজ। শব্দটি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র থেকে উৎসারিত। কিন্তু কে সাবেকি প্রকৃত পপুলিস্ট আর কে গণতন্ত্রের শত্রু, আজ সেই ফারাক করাও কঠিন। এই পপুলিস্ট নৈরাজ্য থেকে সৃষ্ট হচ্ছে দুর্বল মানুষের শক্তিপুজোর আরাধ্য-দেবতা।

নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর তিন বছর অতিবাহিত। এখন বোঝা যাচ্ছে তিনিও নিছক এক জন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি নরেন্দ্র মোদী। তিনি উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীক, তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের সত্তা, এই দুর্বল ভারতীয় জনসমাজের সামনে ৫৬ ইঞ্চির ছাতির এক শক্তিশালী পুরুষ। এলিয়ট বলেছিলেন, বর্তমান সময় এবং অতীতের সময় দুটোই আসলে ভবিষ্যৎ সময়ের মধ্যে স্থিত। আবার ভবিষ্যৎ সময় অতীতের গর্ভেই রয়েছে লুকিয়ে। গ্রিক সভ্যতা নয়, ভারতীয় সভ্যতার আদিপর্বেই লুকিয়ে রয়েছে গণতন্ত্রের ঐতিহ্যের ইতিহাস। এ হল আমাদের গর্ব। হেরোডোটাস নয়, ভারতীয় বৈদিক যুগ থেকে কৌটিল্য, আকবর হয়ে গাঁধী— বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের গভীর ভাবনার উত্তরাধিকারী আমরা। কিন্তু আজ ২০১৭ সালের স্বাধীনতা দিবসে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদীর সুবচন শুনে কী মনে হল?

মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নের কথা যতই বলুন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে কি এক নতুন ধরনের জেনোফোবিয়ার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা? রাজনীতির এ এক নতুন আলেখ্য। আর্থিক বৈষম্য বাড়ছে। কর্মহীনতা তীব্র থেকে তীব্রতর। কৃষকদের আত্মহত্যা চলছে একই ভাবে। নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পর একই ভাবে কালো টাকার কারবার চলছে। সন্ত্রাস দমনে জাল নোট ব্যবহারও বন্ধ হল না। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের শতকরা হার আশাব্যঞ্জক নয়। উল্টে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ কমছে। আর এই সব সমস্যা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা। পপুলিস্ট নেতা নিজেই দেশে জাতীয় বিতর্কের আলোচ্যসূচি স্থির করে দিয়েছেন। সেটি হল সাম্প্রদায়িকতা বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বিতর্ক। সিবিআই ও এনফোর্সমেন্টের তদন্তের মাধ্যমে দেশ জুড়ে বিজেপি সরকারের আলোচ্য হয়ে উঠছে দুর্নীতি। আর এই বিতর্কের মধ্যে মোদীর পক্ষে জয়ধ্বনি কমছে কোথায়?

শাসনের দুটি দিক আছে। একটি হল বৈধতা বা লেজিটিমেসি, অন্যটি হল সুশাসনের দক্ষতা। যাকে বলা যায় প্রশাসনের এফিশিয়েন্সি। ভোটে জেতার ফলে শাসনের বৈধতা অর্জন করে শাসক দল ও তার নেতা। কিন্তু এর পর পাঁচ বছরে প্রতিনিয়ত সুশাসনের প্রমাণ দিতে হয়। পপুলিস্ট নেতা মনে করেন, ‘আমি রাজা। কিসে মানুষের কল্যাণ তা আমি জানি।’ যেমন ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রের এক নয়া সাংস্কৃতিক নীতিতে স্বাক্ষর করেন। তিনি ঘোষণা করেন, রাশিয়া ইউরোপ নয়। ইউরোপের বহুসংস্কৃতিবাদের উপর তীব্র আঘাত হেনে তিনি বললেন, রাশিয়ার পৌরুষ হল তার রাজনৈতিক শক্তি। পুতিন এই নীতির মাধ্যমে প্রাচীন রাশিয়ার শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে চান। রুশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্লাভোফিল সেন্টিমেন্ট ও রুসোফিল সাংস্কৃতিক নীতিতে ফিরে যাচ্ছেন পুতিন। আবার তুরস্ক আজ ওটোমান ঐতিহ্যে ফিরে গিয়ে কেমাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদকেই বদলে দিতে চাইছে। বলা হচ্ছে এ হল নয়া-ওটোমানবাদ।

নরেন্দ্র মোদীও একেশ্বর, কিন্তু তাঁর কৌশল জনমুখী। হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে ডিজিটাল আধুনিকতাকে মিশিয়ে এক নতুন ভারতীয় সার্বভৌমত্ব। এ এক অদ্ভুত সময়। সামন্ত্রতান্ত্রিক রক্ষণশীলতা আর উদারবাদ— দুই স্ববিরোধের ঐক্য দেখছি আজকের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে ক্লান্ত আমরা লালকেল্লায় আরও একটি বক্তৃতা শুনছি। চিনের সঙ্গে আবার যুদ্ধ হবে কি না সেই শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছি। তবু বলছি, মোদী আজও জনপ্রিয়। তিনি স্বৈরতন্ত্রী, তা হোক, তিনি পপুলিস্ট নেতা।

পপুলিস্ট নেতা কে? মেক্সিকোর রাজনীতি-বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন আরদিতি বলেছেন, তিনি নৈশভোজে আসা সম্পুর্ণ মাতাল এক অতিথি, যিনি টেবিল ম্যানার্স মানছেন না, যিনি খুব উদ্ধত, কর্কশ। এমনকী তিনি অন্য অতিথিদের স্ত্রীদের সঙ্গে নৈশভোজে সকলের সামনে ফ্লার্টিং শুরু করে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝেই বক্তৃতা দিয়ে সকলকে উদার গণতন্ত্রের কথা স্মরণ করাচ্ছেন আর বলছেন, মানুষের এই সার্বভৌমত্বের কথা সবাই ভুলেছে। আমাদের কিন্তু কিছুতেই সে কথা ভুললে চলবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন