গুজরাতের ফলাফলের পর কংগ্রেস সমর্থকদের উল্লাস।—ছবি এএফপি
অনেক দিন পরে কংগ্রেসে উল্লাস ফিরল। প্রত্যাশার চেয়েও ভাল ফল হয়েছে দিল্লি দখলের তথাকথিত সেমিফাইনালে। লাড্ডু, মিষ্টি, আতসবাজি, আবির, বাজনা, অভিনন্দনের বন্যা— ভোপাল, জয়পুর এবং রায়পুরের কংগ্রেস দফতর ঘিরে এখন এই ছবি। তার অবধারিত রেশ নয়াদিল্লির ২৪, আকবর রোডেও। ভারতের নির্বাচনী রাজনীতির নানা মোড়ে এই ছবি বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছে। কিন্তু চেনা ছবিটার পিছনে পিছনে একটা চেনা ফাঁদও হাজির হয়ে যাচ্ছে আসরে— জনমোহিনী রাজনীতির ফাঁদ। ভারত কি সেই ফাঁদ এড়াতে পারবে? খুব বড় প্রশ্ন এটা এই মুহূর্তে।
ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রের দিকে ৩৬০ ডিগ্রি দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে কী কী দেখা যাচ্ছে এই মুহূর্তে?
প্রথমত, দেখা যাচ্ছে, রাতারাতি চাঙ্গা হয়ে ওঠা কংগ্রেসকে, এক ধাক্কায় নিজের গুরুত্ব অনেকটা বাড়িয়ে নেওয়া রাহুল গাঁধীকে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
দ্বিতীয়ত, দেখা যাচ্ছে আচমকা আগের চেয়ে অনেকটা বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা বিরোধী শিবিরকে, বিরোধী ঐক্য নিয়ে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠা নানা আঞ্চলিক শক্তিকে, লোকসভা নির্বাচনের রণকৌশলটা সমন্বয়ের ভিত্তিতে স্থির করার জন্য আরও নিবিড় পারস্পরিক চর্চায় মেতে ওঠা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-চন্দ্রবাবু নায়ডু-এম কে স্ট্যালিন-শরদ পওয়ার-এইচ ডি দেবগৌড়া-ফারুক আবদুল্লা-অরবিন্দ কেজরীবালকে, বিজেপি বিরোধী যুদ্ধে কংগ্রেসের প্রতি আস্থা প্রকাশ করতে থাকা মায়াবতী-অখিলেশকে।
তৃতীয়ত, দেখা যাচ্ছে কিয়ৎ বিষণ্ণ-উদ্বিগ্ন-চিন্তিত বিজেপি-কে, হারের ধাক্কায় ঈষৎ প্রতাপ হারানো মোদী-শাহ জুটিকে, হারের কারণ পর্যালোচনায় ডুব দেওয়া শাসক শিবিরকে, হারানো জনভিত্তি পুনরুদ্ধারের তাগিদে সরকারি নীতি বদলের কথা ভাবতে শুরু করে দেওয়া নেতৃবর্গকে।
আরও পড়ুন: পাঁচ রাজ্যে ভোটের ধাক্কা সামলাতে শেষমেশ ভরসা খয়রাতি!
বিপদের আশঙ্কাটা তৈরি হচ্ছে এই তৃতীয় ছবিটা থেকেই। এ-ও খুব চেনা ছবি। নির্বাচনী ধাক্কা আগেও অনেক বার শাসককে নীতি বদলাতে বাধ্য করেছে। নীতি বদলানো কোনও নিষিদ্ধ কাজ নয়। জিএসটি-র রূপায়ণে যদি কোনও ভ্রান্তি হয়ে থাকে, তা হলে শুধরে নেওয়াই উচিত। নোটবন্দি যদি ঐতিহাসিক ভুল হয়ে থাকে, তা হলে শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং ভুল পদক্ষেপজনিত ক্ষতির পূরণের কথা ভাবা উচিত। মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেল ও রান্নার গ্যাসের আগুন দাম যদি মধ্যবিত্তকে সত্যিই বেকায়দায় ফেলে থাকে, তা হলে সুরাহার যুক্তিযুক্ত পথ খোঁজা উচিত। ফসলের দাম না পেয়ে, অনাবৃষ্টির শিকার হয়ে, ঋণের জাল থেকে মুক্ত হতে না পেরে দেশের প্রান্তে প্রান্তে কৃষক যদি গভীর সঙ্কটে থাকেন, তা হলে অবশ্যই পাশে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু এই সুরাহা বা সহায়তার বন্দোবস্তটা হবে কোন পথে, সেটা খুব বড় প্রশ্ন। কারণ জনসাধারণের সুরাহার নামে বল্গাহীন ভাবে জনমোহিনী হয়ে ওঠার ফাঁদ এড়াতে পারেনি এর আগের অনেকগুলো সরকারই। জনমোহিনী নীতিতে ক্ষোভ হয়তো সামাল দেওয়া যায়, হারানো জনভিত্তিও কখনও কখনও পুনরুদ্ধার করে নেওয়া যায়। তাতে শাসকের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হয় ঠিকই, কিন্তু দেশ উপকৃত হয় না, জনগোষ্ঠীর একটা অংশের বা বড় অংশের সাময়িক স্বস্তি অনেক বড় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনে।
কৃষক অসন্তোষ যে বাড়ছে, সে আঁচ বিজেপি পাচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। কখনও মহারাষ্ট্র, কখনও তামিলনাড়ু, কখনও মধ্যপ্রদেশ উত্তাল হচ্ছিল কৃষক বিক্ষোভে। তার আঁচ বার বার পৌঁছে যাচ্ছিল দিল্লিতে। গুজরাত বা কর্নাটকের নির্বাচনে অসন্তোষের ফলটাও একটু একটু করে ফলতে দেখা যাচ্ছিল। শাসকের গদি টালমাটাল করে দেওয়া ধাক্কাটা দিল মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়। সুতরাং কৃষক অসন্তোষকে আর অবহেলা করার জায়গায় বিজেপি নেই। দেশের শাসক দলকে এ বার কিছু করতেই হবে বিরাট কৃষিজীবী জনসংখ্যাটার জন্য। সে বিষয়ে ইতিমধ্যেই আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে বলেও বিজেপি সূত্রে এবং ক্ষমতার অলিন্দ সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। গোটা দেশে কৃষকদের প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকার যে ঋণ রয়েছে, তা পুরোপুরি মকুব করা হতে পারে বলে জোর জল্পনা শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন: ছিন্দওয়াড়ার মসিহা, নাকি গ্বালিয়রের মহারাজা, মুখ্যমন্ত্রী কে? বল সেই রাহুলের কোর্টে
এক ধাক্কায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা বইয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় রাজকোষ রয়েছে তো? এই পদক্ষেপের জেরে অন্য কোনও প্রান্ত থেকে বড়সড় বিপর্যয় ঘনাবে না তো? নোটবন্দিতে টালমাটাল হয়েছিল যে অর্থনীতি, ক্ষত সারিয়ে সবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে যে আর্থিক বৃদ্ধি, সে আবার বিপন্ন হয়ে পড়বে না তো? জনমোহিনী রাজনীতির হাতছানিতে এই প্রশ্নগুলোকে অবহেলা করা কিন্তু অনুচিত হবে।
নাগরিকের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য নাগরিক নয়, এ অত্যন্ত অমোঘ সত্য। নাগরিকের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা, নাগরিককে সুখে রাখাই রাষ্ট্রের বা সরকারের কাজ। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে বা বৃহত্তর পরিসরে সুখী হওয়ার স্বার্থে অনেক সময় সাময়িক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সেই ত্যাগ নাগরিক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছায় স্বীকার করতে চান না। অতএব রাষ্ট্রকে তথা সরকারকে কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শুধুমাত্র ভোটের স্বার্থে বা ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে যাবতীয় অপ্রিয় সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা কিন্তু ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করবে। সে কথাটা দেশের শাসক দলকে মাথায় রাখতেই হবে। নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করার অধিকার বিজেপির নিশ্চয়ই রয়েছে। জনসাধারণ বিপন্ন বা সঙ্কটাপন্ন বোধ করলে জনসাধারণের পাশে দাঁড়ানো সরকারের কর্তব্য। সেই কর্তব্য নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে পালন করতেই হবে। কিন্তু কোনও সস্তা কৌশল বা সহজলভ্য পথে সমস্যার সুরাহা করার চেষ্টা করলে চলবে না। এমন কোনও পথ আজ খুঁজে বার করতে হবে, যে পথে হাঁটলে নাগরিকও স্বস্তি পাবেন, রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই। তবে সফল ভাবে সরকার চালানো খুব সহজ কাজ, এমনটা নরেন্দ্র মোদীরা ভাবেন না বলেই আশা করা যায়।