সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সমকামীদের উচ্ছ্বাস। —ফাইল ছবি
সমকামিতা নিয়ে আদালতের রায় বিষয়ে অনেক কথাই শোনা গেল। অনেক উচ্ছ্বাস, পাশাপাশি অনেক মুখ-বাঁকানো পরিহাস। সোশ্যাল মিডিয়ায় একের পর এক কদর্য ঠাট্টা, যেগুলোতে রসবোধের একমাত্র উৎস হল সমকামী সম্পর্কের ‘অস্বাভাবিকতা’ নিয়ে জবজবে বিদ্রুপ। দেখেশুনে ভাবছিলাম, চার দিকের এই সব উত্তেজনা, বিশেষত ‘রসিক’ ব্যক্তিদের রসিকতাপ্রবাহের তলায় একটা জরুরি কথা বোধ হয় চাপাই পড়ে গেল।
ছয় সেপ্টেম্বরের রায়টি যে ঐতিহাসিক, তা অনেক বারই শোনা গিয়েছে। কিন্তু সমকামিতার স্বীকৃতি ছাড়াও এতে আর একটা ঐতিহাসিকতার বিষয় আছে। সেটা হল, নাগরিক ও রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ। এ দেশে এই সম্পর্ক নিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে অনেক ধন্দ তৈরি হয়েছে। না, বাক্যটার মধ্যে ভুল বোঝার এক চুল অবকাশও রাখা যাবে না। নিশ্চয়ই, রাষ্ট্র ও তার নাগরিকের সম্পর্ক সব দেশে সব কালেই গোলমেলে ব্যাপার। এ নিয়ে ভাবনা চিন্তা বিরোধিতা বিক্ষোভের প্রভূত জায়গা সর্বদাই থাকে। কিন্তু গত সাড়ে চার বছর ভারতে বিজেপি শাসনে যা হয়েছে, নাগরিক অধিকারের উপর যে ভাবে একের পর এক ভয়ানক কোপ পড়েছে— সেটা ঠিক সেই স্বাভাবিক আলোচনার পরিসরে পড়ে না। বিষয়টা ইতিমধ্যে একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে।
সমকামিতার ক্ষেত্রটাই ধরা যাক না কেন। এ দেশে সমকামিতার সম্পর্ককে অস্বীকার বা আক্রমণ করা হয়ে আসছে আজ অনেক দিন ধরে। পরাধীন ভারতে, স্বাধীন ভারতে— সমকামিতা সব সময়েই অপরাধ বলে গণ্য হয়েছে। বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশেও যেমন সমকামীদের বিরুদ্ধে পটাপট মামলা ঠোকা হয়েছে, অবিজেপি রাজ্য কেরলেও তেমন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সুপ্রিম কোর্টের সমকামিতা-রায়টির ধাক্কায় বিজেপির আলাদা করে কাহিল বোধ করার কারণ আছে। কেন? কী এমন বলেছেন মাননীয় পাঁচ বিচারপতি, যাতে বিজেপি অপ্রস্তুত, এমনকি আক্রান্ত বোধ করতে পারে?
রায়ের প্রথমেই পরিষ্কার বলা হয়েছে— ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ৩৭৭ নম্বর ধারা নিয়ে মামলায় বিচারবিভাগ স্পষ্ট করে দিতে চায় যে, আর সব ছেড়ে সাংবিধানিক নৈতিকতাই তাঁদের রায়ের প্রধান ভিত্তিভূমি। ‘মেজরিটারিয়ান মর্যালিটি’ নয়, ‘কনস্টিটিউশনাল মর্যালিটি’— সংখ্যাগুরুর নৈতিকতার বদলে সংবিধানে যে নৈতিকতা স্বীকৃত হয়েছে, সেটাকেই মাথায় রাখতে চান তাঁরা।
নভতেজ সিংহ জোহর বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলার রায়ে বিচারপতিদের বক্তব্যগুলি পড়লে তাই দেখব প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র প্রথমেই একটি সরল বাক্যে বলছেন: ‘দ্য ন্যাচারাল আইডেন্টিটি অব অ্যান ইন্ডিভিজুয়াল শুড বি ট্রিটেড টু বি অ্যাবসলিউটলি এসেনশিয়াল টু হিজ় বিয়িং’, অর্থাৎ কোনও ব্যক্তির প্রকৃতিগত আইডেন্টিটি-কে তার অস্তিত্বের অত্যন্ত জরুরি অংশ হিসেবে মানতে হবে। শুনে অদ্ভুত লাগছে তো? মনে হচ্ছে তো, এ আর আলাদা করে বলার কী আছে? নিশ্চয়ই আছে! না হলে সংবিধানে একের পর এক ধারায় কেন-ই বা রাখতে হয়েছিল কথাটা? সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা বলেছিল, দেশের আইনের কাছে ব্যক্তিনাগরিকদের সবাইকে সমান বলে মানতে হবে। ১৫ নম্বর ধারা বলেছিল ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ ইত্যাদির ভিত্তিতে নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। এবং ২১ নম্বর ধারা বলেছিল, নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা যে কোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে। ভারতের দুর্ভাগ্য, এত কিছুর পরও ‘ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’র প্রতি সর্বোচ্চ আদালতকে এমন তীব্র ভর্ৎসনা করতে হয়।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার। এমন যদি হয়, এক নম্বর ব্যক্তি যে ভাবে জীবন কাটাচ্ছেন, তা নিয়ে দুই নম্বর ব্যক্তির প্রবল ‘নৈতিক’ আপত্তি থাকে? সেটা কি দুই নম্বর ব্যক্তির বাক্স্বাধীনতা নয়? ভারতের সংবিধান বলবে, দুই নম্বরের আপত্তি গ্রাহ্য হতে পারে একমাত্র তখনই, যদি সেটা দেশের সাংবিধানিক নীতির পরীক্ষায় পাশ করে। নতুবা সেই আপত্তি স্বীকারযোগ্য নয়। মতপ্রকাশের অধিকার থাকতেই পারে, কিন্তু সেই মতপ্রকাশের উপর ভিত্তি করে কোনও বৈষম্য করা চলবে না। আর মতপ্রকাশের ক্ষেত্রেও নাগরিকের কাছে নৈতিকতার একটাই মানদণ্ড হওয়া উচিত— সেটা সংবিধান। কোনও ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু, কারও আলাদা নৈতিকতার সঙ্গে যদি সংবিধানের নৈতিকতার সংঘর্ষ দেখা দেয়, তবে অবশ্যই দ্বিতীয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এ ভাবে ভাবলে কিন্তু কথাটা আর অত সহজ থাকে না। বুঝে নিতে হয়, সমকামী বলে যে সব ঠাট্টা-বিদ্রুপ অহরহ চলছে, সেগুলোও সংবিধানসম্মত হচ্ছে না। এই জায়গাটা থেকেই সূত্র তুলে নিয়েছেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তাঁর বয়ান বলছে, ভারতীয় আইনবিধির ৩৭৭ নম্বর ধারার সঙ্গে সংবিধানের ধারাগুলির সরাসরি সংঘর্ষ আছে বলে ৩৭৭-কে সমর্থন করা যায় না। আইনের ধারাটিকে নিয়ে এ বার ঠিক কী করণীয়, সেটা ভাবার দায় অবশ্য আইনবিভাগের, অর্থাৎ জনপ্রতিনিধিদের। তবে কিনা, জনপ্রতিনিধিরা যে সাধারণত ভোট-যুক্তিতে কাজ করেন, সংবিধানের যুক্তি মেনে চলেন না, জাস্টিস চন্দ্রচূড় এবং জাস্টিস নরিম্যানের রায়ে সেই অভিযোগ পরোক্ষে ফুটে উঠেছে।
লক্ষণীয়— সর্বোচ্চ আদালত যখন মনে করিয়ে দেয়, সাংবিধানিক নৈতিকতা তুলে ধরাই রাষ্ট্রের একমাত্র কাজ, তার অর্থ কিন্তু দেশের আইনবিভাগ ও শাসনবিভাগের দিকে একটি প্রত্যক্ষ বার্তা পাঠাতে চায় বিচারবিভাগ। সেই বার্তা কেবল ৩৭৭ ধারার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। বার্তাটি এই প্রথম বার দেওয়া হল, এমনও নয়। গত বছর অগস্টে পাশ হওয়া ‘প্রাইভেসি ভার্ডিক্ট’-টির কথা মনে করি। আধার মামলার সেই রায়েও শোনা গিয়েছিল, নাগরিকের ব্যক্তি-পরিসর এতই গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশাসনিক যুক্তিতেও রাষ্ট্র সেখানে প্রবেশ করে ছড়ি ঘোরাতে পারে না। নাগরিক কী খাবেন কী পরবেন সে সব একান্ত ভাবেই তাঁর নিজের ব্যাপার, আর কারও নজরদারি সেখানে মেনে নেওয়া হবে না।
পথিক নিশ্চয়ই পথ হারাচ্ছেন না? নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন বিজেপি সরকার উদ্বিগ্ন হতে পারে এই সব কথায়? ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বকে সংখ্যাগুরু ঠাহরে যাঁরা গোটা দেশকে সেই ‘গুরু’র গৌরবে টেনে আনতে চান, ধর্মজাতলিঙ্গযৌনতা সব রকম বিভেদচিহ্নকে হেলায় ঠেলে ফেলে দিতে চান বিস্মরণের খাদে, কেনই বা তাঁদের পছন্দসই হবে সাংবিধানিক নৈতিকতার উপর এতখানি জোর? সরকারে যে দল, তার সর্বভারতীয় প্রধান যদি বলেন, গোমাংস খাওয়ার ‘অপরাধ’-এ গণপিটুনিতে নিধনের ঘটনাতে তাঁদের কিছুই আসে-যায় না— সেই দলের কেমন লাগতে পারে এই বার্তা? বিজেপি নেতারা নিজেরাও এক বাক্যে মানবেন, বৈষম্যমূলক আচরণের উপরই তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ পুরোদস্তুর ভর করে আছে। তাঁদের ‘গুরু’-দৃষ্টির সামনে ‘সংখ্যালঘু’ ‘যা-ইচ্ছে-তাই’ করবে, এ তাঁরা প্রাণ গেলেও মানবেন না। যৌনতার ক্ষেত্রে সমকামিতা সেই যা-ইচ্ছে-তাই। খাওয়ার ক্ষেত্রে গোমাংস। বিবাহের ক্ষেত্রে ভিনধর্মের সঙ্গী নির্বাচন। শিল্পকলার ক্ষেত্রে তাজমহলের মতো সৌধ নির্মাণ। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে মুসলিম গৌরবনির্ভর সিনেমা বানানো। আর প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে পাকিস্তান। এই সব ‘সংখ্যালঘুপনা’ যদি ঠেকানো না-ই যায়, তা হলে বিজেপির হাতে রইল কী?
ভীমরাও অম্বেডকরের প্রজ্ঞার সঙ্গে দূরদৃষ্টিও আমাদের অবাক করে। ১৯৪৮ সালের ৪ নভেম্বর ‘ড্রাফট কনস্টিটিউশন’ পেশ করার সময় তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতায় জর্জ গ্রোট-এর কতগুলি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে বলা আছে, সরকারকে যদি ‘সুস্থ ভাবে’, ‘শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি’র মধ্যে কাজ করতে হয়, তবে দেশের সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু সকলকেই সংবিধানের কতগুলি মৌলিক ‘ফর্ম’ বা আকারের উপর ভরসা রাখতে হবে, আর সেই ‘ফর্ম’ মেনে চলার ‘বাধ্যতা’ দেখাতে হবে। অর্থাৎ সেই ফর্ম না মানলে আর সংবিধানের প্রতি বাধ্যতা না থাকলে, সরকারের কাজকর্মে ‘সুস্থতা’ ও ‘শান্তি’ থাকা সম্ভব নয়।
তাই, অমিত শাহের মুখে যখন শুনি, ‘‘আখলাক ঘটার সময়েও আমরা জিতেছি, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যখন প্রতিবাদে সরকারি পুরস্কার ফিরিয়ে দিলেন তখনও জিতেছি’’— অম্বেডকরের কথা থেকেই বুঝে নেওয়া যায় যে ‘সুস্থতা’ বা ‘শান্তি’ অমিত শাহদের শাসনের উদ্দেশ্যও নয়, বিধেয়ও নয়। তাঁরা কেবল জয় চান। কেবল ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্ট তিরস্কার করছে তো কী— তাঁরা ক্ষমতা-বধির!