বিচ্ছিন্ন উপত্যকা কী ভাবছে

কাশ্মীরের ‘উপকার’ হল ভাবছেন প্রধানমন্ত্রী, কাশ্মীরিরা তা বুঝল কি

দ্বিতীয় মোদী সরকার ১০০ দিন পার করে ফেলল। এই ১০০ দিনের মধ্যে ৩৪ দিন কাশ্মীরের সঙ্গে বাকি ভারতের প্রায় কোনও যোগাযোগ নেই।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share:

জুনেইদ ইসলামের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ন’বছর আগে। শ্রীনগরের মহারাজা হরি সিংহ হাসপাতালে। জুনেইদ তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। ১১ বছর বয়স। হাসপাতালের খাটে শুয়ে ডান হাতটা লম্বা করে পাশে ছড়িয়ে রেখেছিল। কনুইয়ের উপরে মোটা ব্যান্ডেজ। কনুইয়ের নীচে হাতে লাল ইংরেজি হরফে লেখা, ‘আমার কী চাই? আজাদি’।

Advertisement

হাতে গুলি লেগেছিল জুনেইদের। কোচিং ক্লাস থেকে বাড়ি ফেরার সময়।

২০১০। সেটাও সেপ্টেম্বর মাস। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সবে ‘পেলেট গান’ আসতে শুরু করেছে। সেই পেলেট গান-এর ছোট ছোট গুলি জুনেইদের হাতে বিঁধেছিল। কাশ্মীর উপত্যকা তখন অনন্ত কার্ফু-র দেশ। ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে মানুষ কার্ফুর জন্য ঘরবন্দি। শ্রীনগরের লাল চকের যে তিনতলা হোটেলে ঠাঁই মিলেছিল, তাতে আর কোনও বাসিন্দা ছিলেন না।

Advertisement

ন’বছর পরে ফের কাশ্মীরে টানা কার্ফু। তার মধ্যেই ১৬ বছরের আসরর আহমেদ খানের মৃত্যুর খবর শুনে আবার জুনেইদের কথা মনে পড়ে গেল। হিসেব মতো এত দিনে জুনেইদ ২০ বছরে পা দিয়েছে। জুনেইদের থেকেও বয়সে ছোট আসরর পাড়ার গলিতে ক্রিকেট খেলছিল। পরিবারের দাবি, সে সময় তার মুখের সামনে পেলেট গানের গুলি ফাটে। প্রায় এক মাস হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে আসরর হেরে যায়।

দ্বিতীয় মোদী সরকার ১০০ দিন পার করে ফেলল। এই ১০০ দিনের মধ্যে ৩৪ দিন কাশ্মীরের সঙ্গে বাকি ভারতের প্রায় কোনও যোগাযোগ নেই। মোদী সরকার আবার ক্ষমতায় ফেরার পরে প্রথমেই কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করেছে। তার পর থেকেই কাশ্মীর উপত্যকা বাকি ভারতের থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন। মোবাইল পরিষেবা কাজ করছে না। ইন্টারনেট বন্ধ। শ্রীনগরের রাস্তায় রাস্তায় প্যাঁচানো কাঁটাতারের বেড়া। স্কুল-কলেজ বন্ধ। বাকি ভারত কেন! কাশ্মীরের এ পাড়ার লোকেরাই অন্য পাড়ায় আত্মীয়-স্বজনের খবর জানেন না। দিল্লিতে পড়তে আসা কাশ্মীরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাবা-মা, ভাই-বোনের যোগাযোগ নেই। মোবাইল-হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক চ্যাটের যুগে কাশ্মীর যেন হঠাৎ করেই প্রস্তরযুগে ফিরে গিয়েছে।

এখানেই ম্যাজিক। আরও স্পষ্ট করে বললে, ‘মোদী ম্যাজিক’। নরেন্দ্র মোদী সরকারের মন্ত্রীরা এখন নানা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ১০০ দিনের সাফল্য বর্ণনা করছেন। সেই তালিকায় প্রথমেই, ১০০ দিনের প্রধান সাফল্য— কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করা। হতে পারে, কাশ্মীরের সঙ্গে বাকি ভারতের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কিন্তু মন্ত্রীরা দাবি করছেন, কাশ্মীর আসলে এত দিন যাবৎ বিচ্ছিন্ন ছিল। নরেন্দ্র মোদীই ৩৭০ রদ করে জম্মু-কাশ্মীরকে বাকি ভারতের সঙ্গে যুক্ত করলেন।

গত সত্তর বছরে যে ‘সাহস’ কেউ দেখাননি, নরেন্দ্র মোদী তাঁর সেই সাহসেই গোটা দেশকে মজিয়ে ফেলেছেন। জয়ধ্বনি উঠেছে গোটা দেশে। অর্থনীতির অবস্থা ভাল নয়। একের পর এক গাড়ি কারখানায় কাজ বন্ধ হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ লোকের চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঠিকে শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরছেন। কিন্তু তাঁদের মুখেও মোদীর নাম-গান। মোদী করে দেখালেন বটে! কাশ্মীরের সমস্যার এ বার সমাধান হল। পাকিস্তানের ইমরান খান কেমন একেবারে দিশেহারা! দুনিয়ায় কেউ পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াচ্ছে না! এ বার সন্ত্রাসবাদও বন্ধ হবে!

১৬ বছরের আসরর মেধাবী ছাত্র ছিল। তার পেলেট-বিদ্ধ মৃত মুখ চাপা পড়ে গিয়েছে এই জয়ধ্বনিতে। কাশ্মীর উপত্যকার ২৫ হাজার ছেলেমেয়ের এখন দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। স্কুল, কোচিং ক্লাস শিকেয় উঠেছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে পরীক্ষা হবে কি না, জানা নেই। এ সব প্রশ্ন জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেমের আবেগে ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। কাশ্মীরিদের অসুবিধা হলে হোক। আসল কথা হল, ‘কাশ্মীর হমারা হ্যায়’।

তিন বছর আগে, ২০১৬-র ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিল-কাণ্ডের সঙ্গে সব কিছুর বড্ড মিল। আচমকা ৫০০, ১০০০ টাকার যাবতীয় নোট বাতিল করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এক মিনিট আগে পর্যন্ত কাকপক্ষীতেও টের পায়নি। এ বারও ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার আগে পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি, এমনটাই হবে। মিল শুধু এটুকুই নয়। তিন বছর আগে নরেন্দ্র মোদী নোট বাতিল ঘোষণার পরে বলেছিলেন, মানুষের একটু অসুবিধা হবে। কিন্তু মাত্র কয়েক দিন। কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতাই আসল। এ বার ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করেও প্রধানমন্ত্রী ৮ অগস্ট জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় বলেছেন, কাশ্মীরের মানুষের কিছু দিন অসুবিধা হবে। কিন্তু যত দিন যাবে, সমস্যা কমতে থাকবে। কাশ্মীরে উন্নয়নের জোয়ার আসবে।

নোট বাতিলের পরে আমজনতার অসুবিধা হয়েছিল। এটিএম-এর সামনে লম্বা লাইন। পুরনো নোট বদলাতে হেনস্থা। দিন আনি, দিন খাই, গায়ে-গতরে খেটে বেঁচে থাকা মানুষ থেকে ছোট ব্যবসায়ী, শহরে কাজ করতে গিয়ে কাজ হারানো গ্রামের মানুষের উপরে কোপ পড়েছিল সব থেকে বেশি। কিন্তু ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদীর ভোট আরও বেড়েছে। হলফ করে বলা যায়, নোট বাতিলের ঠেলায় জেরবার হওয়া বহু মানুষও নরেন্দ্র মোদীকে ভোট দিয়েছেন। মোদী বোঝাতে পেরেছিলেন,
নোট বাতিলের ফলে কিছু দিন অসুবিধা হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কালো টাকার মালিকরা আরও বেশি বিপাকে পড়েছে।

এ বার অর্থনীতির ঝিমুনির ফলে আবার সেই গরিব, খেটেখাওয়া মানুষের উপরেই কোপ পড়েছে বেশি। পরিসংখ্যানবিদ প্রণব সেন বলেছেন, অর্থনীতির এই মন্দগতির মূলে সেই তিন বছর আগের নোট বাতিল। তা থেকেই বাজারে নগদে টান। বিক্রিবাটা কমতে থাকা। কিন্তু রুটিরুজি হারানোর ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা মানুষকেও নরেন্দ্রভাই কোনও এক জাদুবলে বুঝিয়ে ফেলেছেন, কাশ্মীর বগলদাবা হল। পাকিস্তান জব্দ হল। রুটিরুজিতে টান সে তুলনায় তুচ্ছ। অনেকটা যেন হীরক রাজার মগজ ধোলাইয়ের মন্ত্র: ‘যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান!’ তার পর দেশে বাকি যেটুকু সমস্যা থাকবে, ‘বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারী’দের দেশ থেকে তাড়ানো হলেই তা মিটে যাবে।

বামপন্থী অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ক লিখেছেন, আমেরিকা থেকে ইউরোপ— গোটা বিশ্বেই এমনটা চলছে। ‘দক্ষিণপন্থী’রা রুটিরুজির সমস্যা, বেকারি সবই বোঝেন। তার জন্য অর্থনীতির সমস্যার দিকে আঙুল না তুলে বেআইনি অনুপ্রবেশকে দায়ী করেন। অনুপ্রবেশ ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি, তাতেই সমস্যা মিটে যাওয়ার স্বপ্নে মানুষ দক্ষিণপন্থীদেরই আরও আঁকড়ে ধরেন। এ দেশেও মোদী সরকার তাই ‘বিকাশ’ থেকে ‘পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা’, ‘দেশের নিরাপত্তা’, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’র গল্পে সরে গিয়েছে।

সে গল্প না-হয় বাকি ভারতে শোনানো হল। কাশ্মীরের মানুষ কি তা শুনবেন?

এমন নয় যে ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদায় কাশ্মীরিদের উনুনে হাঁড়ি চাপত। কিন্তু কাউকে ঘরবন্দি করে, মুখ বন্ধ করে দিয়ে, এক বার জিজ্ঞাসাও না করে অকিঞ্চিৎকর কিছু কেড়ে নেওয়া হলেও আত্মমর্যাদায় ঘা লাগতে বাধ্য। কাশ্মীরের মানুষের ক্ষোভ আসলে সেটাই। যত দিন এ ভাবে গায়ের জোরে আটকানো হবে, তত বেশি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির অন্দরে ক্ষোভের লাভা জমবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অবশ্যই আশা করছেন, কাশ্মীরের মানুষও বুঝবেন এতে তাঁদের উপকারই হল। কিন্তু সেই বোঝানোর চেষ্টা কবে হবে?

জুনেইদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার হাতে কি এখনও লাল হরফে লেখা রয়েছে: ‘আমার কী চাই? আজাদি!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন