ধুলার দুলাল

রাজ্যের সব কয়টি বড় ও মাঝারি পুর-এলাকা ধরিলে গৃহহীন শিশুদের সংখ্যা লক্ষাধিক হইবে। কিন্তু এই হিসাবে বাস্তবিক সংখ্যার আন্দাজ পাওয়া কঠিন। সমীক্ষকেরা দেখিয়াছেন, ইটভাটা, গৃহনির্মাণ, ধাবা, গৃহকাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রের বাহিরে রহিয়া যায় এক বিপুল সংখ্যক পথশিশু, যাহাদের কাজ বা বাসস্থান নির্দিষ্ট নহে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:২২
Share:

পথশিশুদের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন চাহে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের সংখ্যা গণনা হইতেছে। গৃহহীন, প্রায়শ অভিভাবকহীন শিশুর নিরাপত্তা কী করিয়া নিশ্চিত হইবে, তাহা এক কঠিন প্রশ্ন। কেবল কলকাতা ও হাওড়ায় অন্তত বাইশ হাজার পথশিশুর খোঁজ মিলিয়াছে একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষায়। ওই দুই শহর-সহ আসানসোল, মালদহ, শিলিগুড়ি এবং খড়্গপুরে পথশিশু গণনা চলিতেছে। রাজ্যের সব কয়টি বড় ও মাঝারি পুর-এলাকা ধরিলে গৃহহীন শিশুদের সংখ্যা লক্ষাধিক হইবে। কিন্তু এই হিসাবে বাস্তবিক সংখ্যার আন্দাজ পাওয়া কঠিন। সমীক্ষকেরা দেখিয়াছেন, ইটভাটা, গৃহনির্মাণ, ধাবা, গৃহকাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রের বাহিরে রহিয়া যায় এক বিপুল সংখ্যক পথশিশু, যাহাদের কাজ বা বাসস্থান নির্দিষ্ট নহে। কেহ শহরে কাহারও বাড়িতে আশ্রিত হইয়াও কার্যত পথে বাস করে, কেহ গ্রাম হইতে কখনও কখনও আসিয়া রাস্তায় থাকে, কেহ ভিক্ষাও করে, কাজও করে। কেহ রাস্তায় ছোটখাটো জিনিস বিক্রয় করিবার সহিত নিজের দেহও বিক্রি করে। জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা তাহাদের কোনও একটি বিভাগে চিহ্নিত করিবার পথে বাধা হইয়া দাঁড়ায়। অতএব সংখ্যাকে কেবল ইঙ্গিত বলিয়া ধরিয়া পুনর্বাসনের নীতি প্রণয়ন করিতে হইবে।

Advertisement

নীতি তৈয়ারি করিতে হইলে জানা প্রয়োজন, কেন ভিন্‌রাজ্য বা গ্রাম হইতে আসিয়া শিশুরা শহরের পথে আশ্রয় লইতেছে। প্রচলিত মত হইল, দারিদ্রই ইহার কারণ। গ্রামগুলিতে রোজগারের যথেষ্ট সুযোগ নাই, তাই কখনও গোটা পরিবার, কখনও কেবল শিশু-কিশোরেরা শহরে বাস করিতে আগ্রহী। এই মত মানিয়া লইলে গ্রামীণ রোজগার বাড়াইবার নানা প্রকল্পকে আরও কার্যকর করিবার, সেগুলির জন্য আরও টাকা বরাদ্দ করিবার নীতি গ্রহণ করিতে হইবে। কিন্তু তাহাতে শহরে শিশুদের আগমন কমিবে কি? নৃতত্ত্ব এবং অর্থনীতির গবেষকরা দেখিয়াছেন, দারিদ্র শিশুদের ঘর ছাড়িবার একটি প্রধান কারণ হইলেও তাহাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ নহে। পরিবারে মন্দ ব্যবহার, অনাদর, নির্যাতনের জন্যও শিশুরা গৃহত্যাগ করে। দ্বিতীয়ত, নাচার না হইলে তাহারা ঘর ছাড়িয়া শহরে আসে না, এমনও নহে। গ্রামের চাইতে শহরে কাজের সুযোগ, রোজগারের সুযোগ অধিক, সেই কারণে তাহারা স্বেচ্ছায় শহরের নিরাপত্তাহীন জীবন বাছিয়া লইতেছে। অনেক গবেষকের মতে, শহরে আসিলে বাস্তবিকই কিশোর ও তরুণদের আর্থিক উন্নতি হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের শ্রমিক সংস্থা (আইএলও) তাই শিশুদের শহরে আসা বন্ধ করিবার পরিবর্তে, শিশুশ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করিবার প্রস্তাব দিয়াছে।

অতএব নীতি প্রণয়নের বিষয়ে নানা প্রশ্ন উঠিবে। পথশিশুকে পরিবারে ফেরত পাঠাইলেই তাহা ‘পুনর্বাসন’ হইল কি না, শিশু ‘সুরক্ষিত’ হইল কি না, ভাবিতে হইবে। আবার যেখানে গোটা পরিবারই পথে বাসা বাঁধিয়াছে, সেখানে সুরক্ষিত আবাসে শিশুকে রাখিতে গিয়া তাহাকে পরিবার-বিচ্ছিন্ন করা চলিবে কি না, তাহাও বড় প্রশ্ন। লক্ষাধিক শিশুর পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সহ সকল অধিকারের সুরক্ষাও রাষ্ট্রের পক্ষে সহজ নহে। তবে কাজটি যতই কঠিন হউক, তাহা করিতে হইবে। প্রতিটি শিশু অমূল্য, পথ কাহারও আবাস হইতে পারে না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন