ইঁদুর দৌড়ে মেতেছে সাংবাদিকতা

ভারতে বিশ্বায়নের পর সংবাদমাধ্যমেও এক দ্রুত পরিবর্তন এসেছে। আত্মসমালোচনায় জয়ন্ত ঘোষাল কয়েক দিন আগে কলকাতার টলি ক্লাবে কোনও এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত আলোচনাসভায় যোগ দিতে গিয়েছিলাম। ভিড়ে ঠাসা সেই সন্ধ্যার আলোচনাসভার বিষয়বস্তু ছিল ‘সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা’। বিশ্বাসযোগ্যতা কি হারাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়া? বিশেষত, ভোটের সময় মিডিয়ার ভূমিকা কি গ্রহণযোগ্য?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০০:০১
Share:

কয়েক দিন আগে কলকাতার টলি ক্লাবে কোনও এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত আলোচনাসভায় যোগ দিতে গিয়েছিলাম। ভিড়ে ঠাসা সেই সন্ধ্যার আলোচনাসভার বিষয়বস্তু ছিল ‘সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা’। বিশ্বাসযোগ্যতা কি হারাচ্ছে ভারতীয় মিডিয়া? বিশেষত, ভোটের সময় মিডিয়ার ভূমিকা কি গ্রহণযোগ্য?

Advertisement

বক্তা হিসেবে প্রথমেই যে কথাটি বলেছিলাম, সেটি হল, পুলিশ যেমন ভাল পুলিশ এবং খারাপ পুলিশ হন, চিকিৎসক যেমন ভাল ও খারাপ দুই প্রকারই হন, শিক্ষক, এমনকী এক জন দোকানদারের মধ্যেও যদি প্রকারভেদ থাকতে পারে, তবে সাংবাদিকদের মধ্যেও ভাল ও খারাপ, সাদা এবং কালো, এই ভিন্নতা থাকাটাই কি স্বাভাবিক ঘটনা নয়? আমরা কথায় কথায় বলি প্রশাসন ভেঙে পড়েছে। সাংস্কৃতিক অবক্ষয় শুরু হয়েছে। সেই সোনামুগের ডাল নেই, সেই মোহনবাগান নেই। আজ যেটা দেখছি, সেটা হল ‘এজ অফ ডেকাডেন্স’। আর অতীত? সে ছিল এক দিন আমাদের, যৌবনের কলকাতা।

আসলে সাদা ও কালোর মধ্যে ধূসরতা থাকে। সেই ধূসরতার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে প্রকৃত সত্য। অতীতে অনেক কিছু ভাল ছিল। অতীতে অনেক কিছু খারাপও ছিল। আজও অনেক কিছু ভাল, অনেক কিছু খারাপ। সব ব্যবস্থাতেই যদি ঘুণ ধরে, তবে সংবাদমাধ্যম ব্যবস্থায় ঘুণ ধরবে না কেন? মায়ানমারের সামরিক জুন্টা সরকার বিরোধী দলকে স্বীকৃতি দিল এবং স্বাধীন সংবাদপত্রের উপর থেকে বাধানিষেধ প্রত্যাহার করল। দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদমাধ্যমের যে আবহ, সেখানে এটি এক ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু এটাও ঘটনা, ভারতে বিশ্বায়নের পর সংবাদমাধ্যমেও এক দ্রুত পরিবর্তন এসেছে। বাজার অর্থনীতি যেমন গ্রামীণ ভারতকে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বদলে দিয়েছে অনেকটাই, সে ভাবে সংবাদমাধ্যমও— কি প্রিন্ট, কি বৈদুতিন, এসেছে এক বিপুল পরিবর্তন। স্থানীয় ভাষার সাংবাদিকতাতেও পরিবর্তন কিছু কম হয়নি। পাঠক এবং বাজার এই সম্পর্কটি জটিল। যিনি পাঠক, তিনিই উপভোক্তা। কলেজ জীবনে যখন লিটল ম্যাগাজিন বার করতাম, তখন পেশাদারি হতে চেষ্টা করলেও বাণিজ্যিক হওয়ার কথা ভাবিনি। বস্তুত, বাবা এবং কিছু আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সৌজন্যে ‘স্পেস ডোনেটেড বাই ওয়েল উইশার’ এই ছদ্মনামেই নিহিত ছিল পত্রিকার অর্থনীতি। সে দিন যেমন সম্পাদকীয় উপাদানে কোনও আপস করতে হয়নি, ঠিক সেই ভাবে পত্রিকাটি আমজনতার কাছেও পৌঁছয়নি। এই রকম কত লিটল ম্যাগাজিন জন্মেছে এবং অবলুপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক সততার পরাকাষ্ঠা হয়ে নিষ্ফল মাথা কুটে মরেছে। একই ঘটনা দেখেছি গ্রুপ থিয়েটার ও যাত্রায়। অ্যাকাডেমিতে গ্রুপ থিয়েটার যত মানুষের কাছে পৌঁছত, তার থেকে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছত যাত্রা। চিৎপুরের অর্থবলও ছিল অনেক বেশি।

Advertisement

এখন তো অনেকে বলছেন, সম্পাদকরা আসলে কর্পোরেট এডিটোরিয়াল ম্যানেজার। সাংবাদিকরা হলেন কর্পোরেট এডিটোরিয়াল এগজিকিউটিভ। কর্পোরেট পলিসি ও সম্পাদকীয় নীতিতে কোনও ফারাক নেই। সাংবাদিকরা সেই নীতির প্রয়োগে ব্যস্ত।

স্বাধীনতার সময়ে স্থানীয় ভাষার সংবাদপত্রেরও কিন্তু বিশেষ ভূমিকা ছিল। সেই ভূমিকা এখনও আছে। ১৯৯৫ সালের ন্যাশনাল রিডারশিপ সার্ভে বলছে, সব থেকে বেশি পঠিত হিন্দি সংবাদপত্র এ দেশে হল পঞ্জাব কেশরী। যার পাঠক সংখ্যা ৩.৭ মিলিয়ন। তামিল থান্থি, তার পাঠকসংখ্যা ৩.৬ মিলিয়ন। ১৯৯৪ সালের রেজিস্টার্ড নিউজপেপার অফ ইন্ডিয়া-র (আরএনআই) বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৯৬টি ভাষায়/ডায়ালেক্টে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। হিন্দি সংবাদপত্র প্রকাশিত ১২ হাজার ৫৯৬টি। ইংরেজিতে ৫৩১৬টি সংবাদপত্র আছে। আর বাংলায় ২০৩৬টি। পাঠকসংখ্যা কিন্তু হিন্দি ও বাংলায় ক্রমশ বাড়ছে বই কমছে না। টেলিভিশনের উপস্থিতিও এই সংখ্যাকে কমাতে পারেনি। সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা অনেক সময়েই সম্পাদকীয় কর্পোরেট পলিসির নিন্দা করে নিজেরা হাত ধুয়ে ফেলি। বৃহৎ সংবাদপত্রের এক জন সাংবাদিকেরও কিন্তু একটি স্বাধীন ভূমিকা থাকে। বরং ছোট ছোট কাগজে সামন্ততান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ বেশি। সেখানে একটি পাঁজির বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করতে গেলে সম্পাদকের নজর না এড়িয়ে করা যায় না। কিন্তু বৃহৎ সংবাদপত্রে স্কটিশ দার্শনিক তথা অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের প্রভাব বোধহয় বেশি। কাজেই সাংবাদিকদেরও হাত ধুয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই। পাঠক কী চাইছে, আর পাঠককে আমি কী পরিবেশন করব, এটা অনেকটা হাঁস আগে না ডিম আগে, সেই বিতর্কের মতো।

কিছু দিন আগে এক গৃহশিক্ষিকার এক শিশুছাত্রকে পেটানোর ছবি, সিসিটিভি-তে তোলা ফুটেজ যে ভাবে সারা দিন ধরে দেখানো হয়েছে তাতে আমি এমন কোনও সাংবাদিক খুঁজে পাইনি যার মনে হয়েছে যে এত ক্ষণ ধরে এটা দেখানোটা একটা উচিত কাজ। তবু এটা দেশের সমস্ত চ্যানেল দেখিয়েছে। ‘ক’ না দেখালে ‘খ’ দেখাবে। কাজেই টিআরপি প্রতিযোগিতা এ এক নয়া ইঁদুর প্রতিযোগিতা। ফেসবুক ও সোস্যাল মিডিয়াতে প্রবল নিন্দার ঝড় ওঠে এই ফুটেজ প্রদর্শন নিয়ে। ফেসবুকের এক প্রবীণ সদস্য রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বলেন, হাত জোড় করে বলছি, দয়া করে এ বার থামুন। এ দৃশ্য আর দেখা যাচ্ছে না। এ তো বিবমিষা। কিন্তু নিন্দা করলে কী হবে, সেই প্রদর্শনে কোনও খামতি ছিল না। ইলেকট্রনিক চ্যানেলে এক সাংবাদিক বন্ধুকে বলছিলাম, এ বার তো ধর্ষণের খবর দেখানোর সময় তোরা ধর্ষণের দৃশ্য দেখাবি! সাংবাদিক হয়েও আমার মনে প্রশ্ন, এই হিংসা প্রদর্শনে হিংসা বিরোধী সচেতনতা বাড়ছে না কি মানুষ আরও হিংসাশ্রয়ী হচ্ছে?

১৯৯৮ থেকে ২০০৬, এই অল্প কয়েক বছরের মধ্যে ভারতে ৫০টি স্যাটেলাইট নিউজ চ্যানেলের জন্ম হয়। তার পরেই এটি দ্রুত বেড়ে ৩০০ সংখ্যায় পৌঁছয়। এখন সেই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে যে কোথায় পৌঁছেছে, তা বলার নয়। প্রশ্নটা হল, বাজার অর্থনীতিতে এই চ্যানেলগুলোর টিকে থাকার জন্য, বলা হয় তিনটি ‘সি’ প্রয়োজন। একটি ‘সি’ ক্রিকেট, দ্বিতীয় ‘সি’ সিনেমা, আর তৃতীয় ‘সি’ ক্রাইম বা অপরাধ। আসলে ভারতের মধ্যে দু’টি ভারত আছে। একটি অভিজাত ভারত। যেখানে দিল্লি ও অভিজাত শহরগুলিই সব। আর একটি গ্রামীণ ভারত। একটা প্রত্যন্ত গ্রামের অন্ত্যজ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা লিখলে কি মার্সিডিজ বেঞ্জ বিজ্ঞাপন দেবে? আমি অতীতে যে সংবাদপত্রে ছিলাম, তখনকার অভিজ্ঞতা হল, তার একটি পত্রিকায় প্রচ্ছদ নিবন্ধ শ্রীরামকৃষ্ণ-কল্পতরু উৎসব করা হলে কোনও রিটার্ন আসে না। কিন্তু কোনও বহুজাতিক সংস্থা বিজ্ঞাপন দিতে চায় না। প্রচ্ছদ-নিবন্ধ যদি হয় গাড়ির যত্ন বা লাইফস্টাইল ম্যানেজমেন্ট, তা হলে খুব সহজেই বিজ্ঞাপন আসে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের মালিক কোন পথ নেবেন?

এ বারের লোকসভা নির্বাচনে আর একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার পত্রিকা ‘হিমাল’-এ সুকুমার মুরলীধরন তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, এ বারের ভোটে কর্পোরেট বিজ্ঞাপনদাতারা এবং বিজেপির মিডিয়া কৌশল এক ধরনের ‘ম্যানুফ্যাকচার্ড কনসেন্ট’ তৈরি করেছেন। এই কথাটি ভোটের আগে রাহুল গাঁধীও আমাকে বলেছিলেন। সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে কর্পোরেট সংস্থা একটা হলোগ্রাম তৈরি করেছে। গণতন্ত্রে বিতর্ক সব সময়েই স্বাগত। সে তো বিদেশেও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জোর বিতর্ক শুরু হয়েছে যে নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা বলে আর কিছু আছে কি না। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বার্টন জন এবং পেনসিলভ্যানিয়ার কিরস্টেন জনসন সম্পাদিত একটি বই ‘নিউজ উইথ এ ভিউ’-এ বিভিন্ন প্রবন্ধে বলা হয়েছে, আধুনিক সাংবাদিকতায় নিরপেক্ষতার প্রশ্নে গ্রহণ শুরু হয়েছে। আমি অবশ্য এ বিষয়ে প্রয়াত সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্তর একটি আপ্তবাক্য এখনও মেনে চলি। সেটি হল, কোনও সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিক কোনও ব্যক্তি বা দল যে উঠছে, তাকে টেনে নামাতে পারেন না। আর যে নামছে, তাকে টেনে তুলতে পারে না। তা হলে আমরা পারিটা কী? যে উঠছে, তাকে একটু ধাক্কা দিয়ে আরও একটু দ্রুত তুলে দিতে পারি। আর যে নামছে, তাকে ধাক্কা দিয়ে তার পতন আরও ত্বরান্বিত করতে পারি। এটা হল প্রকৃতির আইন। বলা যায়, সাংবাদিকতার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। কাজেই নরেন্দ্র মোদীর উত্থানের সবটাই কর্পোরেট মিডিয়ার কারসাজি, এটাকে আমরা অতি সরলীকরণ বলে মনে করি। আবার দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অনেক ভাল জিনিস অবহেলিত হয়। আর ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় ধারে নয়, নামে কাটে, এমন পণ্যও বহু দেখছি। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেই ব্র্যান্ড সর্বস্বতায় আমাদের দায়িত্ব কম নয়!

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন