টাকা বালি, বালিই টাকা, মানেন হালিশহরের রাজা

সব লাভের গুড় পিঁপড়ের পেটে যায় না। রাজ-তন্ত্রের হালিশহরে সেটা দস্তুরও নয়। ফলে, ‘পিঁপড়েরা’ যতই আশা করুক, সে গুড়ে বালি। বালি-কারবারের লাভ থেকে তাই সরতে হয়েছে ‘পিঁপড়ে’দের। হালিশহরে সেই কারবারে যে রাজা দত্তেরই ‘মনোপলি’!

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য ও সুপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৬ ০৪:১৩
Share:

এ ভাবেই চলছে বালি তোলার কাজ। হালিশহরে সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

সব লাভের গুড় পিঁপড়ের পেটে যায় না। রাজ-তন্ত্রের হালিশহরে সেটা দস্তুরও নয়।

Advertisement

ফলে, ‘পিঁপড়েরা’ যতই আশা করুক, সে গুড়ে বালি। বালি-কারবারের লাভ থেকে তাই সরতে হয়েছে ‘পিঁপড়ে’দের। হালিশহরে সেই কারবারে যে রাজা দত্তেরই ‘মনোপলি’!

পুকুর বা জলাজমি ভরাটের কারবার হালিশহর পুরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান রাজাকে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে দিয়েছে, তা হালিশহরের সকলেই জানেন। আর পুকুর-ভরাটের জন্য সব চেয়ে ভাল কাঁচামাল বালি। তাই গঙ্গা থেকে বালি তোলার কাজে রাজা কোনও খামতি রাখেন না বলে অভিমত তার চ্যালাদেরই। তাদেরই এক জনের কথায়, ‘‘রাজাবাবু জানেন, বালিই টাকা দেয়। তার প্রতিপত্তির শুরু তো ওই কারবার দিয়েই!’’

Advertisement

গঙ্গার পাড়-লাগোয়া কাঁচরাপাড়ার বাগ মোড় থেকে হালিশহরের চৈতন্যডোবা পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটার রাজা দত্তের বালি-কারবারের ‘খাসতালুক’ হিসেবেই পরিচিত। দিনে-দুপুরে খুল্লমখুল্লা গঙ্গায় নৌকা বা ভুটভুটির উপর যন্ত্র বসিয়ে নদী থেকে বালি ছেঁকে লম্বা পাইপ দিয়ে তা নদীর পাড়ে পাঠানো হয়। সেখানে বালি জড়ো করে লরি বোঝাই করে তা এলাকার পুকুর-ভরাটের জন্য তো পাঠানো হয়ই, বালি যায় রাস্তার কাজ বা বহুতল নির্মাণের কাজেও। সারা দিনে পাঠানো হয় ১০০-১২০ লরি বালি। রাজার রাজকোষ ভরে ওঠে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বীজপুরের রায়বাড়ির ‘প্রিয়পাত্র’ হওয়ার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি কারবার চালালেও রাজার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। বিরোধীদের অভিযোগ, রায়বাড়ি কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, তা বুঝতে কারও বাকি নেই। তবে, এ নিয়ে এলাকার বিধায়ক শুভ্রাংশু রায় কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘আমি কিছু বলব না।’’

সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন, ওই এলাকা থেকে অবৈধ ভাবে বালি তোলা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক পীযূষ গোস্বামী বলেন, ‘‘ওই বালি-খাদানগুলির বৈধতা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে সেচ দফতর-সহ বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে শীঘ্রই আলোচনা করা হবে।’’

এলাকার লোকজনের দাবি, সামান্য দিনমজুর থেকে বিত্তশালী হয়ে উঠতে রাজার লেগেছে মাত্র বছর চারেক। রাজ্যে পরিবর্তনের পরই রাজার উত্থান। আস্থাভাজন কয়েক জনকে নিয়ে ২০১২ সালের মাঝামাঝি বালির কারবারে নামে রাজা। সেই সময় বাগমোড় এলাকার জনা ছয়েক যুবক বালির কারবার করতেন। রাজা কারবারে নামার পরে তাঁদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ওই দলেরই এক যুবক বলেন, ‘‘বছর দশেক বালির ব্যবসা করেছিলাম। কিন্তু রাজার লোকজন আমাদের এলাকা থেকে সরে যেতে বলে। ব্যবসা চালানোর জন্য রাজাবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু রাজাবাবু দলে নেননি। ঠান্ডা গলায় ব্যবসা থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দেন।’’

ওই যুবকেরা এখন অন্য ব্যবসায় যুক্ত। বালি-কারবার রাজারই একচেটিয়া হয়ে গিয়েছে। রাজার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রথম দিকে রাজার বিশ্বস্ত অনুচর রাজু বালি-খাদানগুলি নিয়ন্ত্রণ করত। পরে রাজার আরও কয়েক জন শাগরেদ রাজুর সঙ্গে যুক্ত হয়। গড়ে প্রতিদিন এই কারবার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা আমদানি হয়। খরচ বাদ দিলে লাভের অঙ্ক প্রায় চার লক্ষ টাকা। সেই টাকার একটি অংশ শাগরেদদের মধ্যে বিলি হয়। বিরোধীদের দাবি, কিছু টাকা যায় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাদের কাছে। তাঁদের অভিযোগ, বাকি টাকা একটি বিশেষ বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় উপরে।

সাধারণ মানুষ বলছেন, এ কারবার এতই লাভজনক যে, শহরের বারেন্দ্র গলির সমাজপতির পরিবারের উপরে হামলার পর থেকে রাজা আত্মগোপন করে থাকলেও বালি তোলায় ভাটা পড়েনি। সোমবারও ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গিয়েছে, কাজ চলছে পুরোদমে। কাতর সুরে সমাজপতি বাড়ির মেয়ে দেবশ্রী ঘোষের জিজ্ঞাসা, ‘‘এত অন্যায় দেখার কি কেউ নেই?’’

হামলার পর থেকে দেবশ্রীরা অবশ্য পাশে পেয়েছেন অনেককে। রবিবার তাঁদের বাড়িতে যান সমাজবিরোধীদের হাত খুন হয়ে যাওয়া বামনগাছির সৌরভ চৌধুরীর বাবা সরোজ এবং মা মিতা চৌধুরী। খুন হয়ে যাওয়া রাজার শাগরেদ বান্টির বাবা শক্তিপদ ঘোষ এবং মা সাধনাও ওই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন