স্বাধীনতার সেলুলয়েডে জীবনের নির্মাণ

স্বাধীনতা-উত্তর যুগে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও তাঁদের সহকর্মীরা চলচ্চিত্র ভাষার স্বরূপ খুঁজে পান। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়স্বাধীনতা-উত্তর যুগে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও তাঁদের সহকর্মীরা চলচ্চিত্র ভাষার স্বরূপ খুঁজে পান। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’

নিঃসন্দেহে বলা যায় স্বাধীনতার পরে সাংস্কৃতিক পালাবদল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে ঘটেছিল আমাদের সিনেমায়। এ নয় যে সাহিত্যে অথবা নাটকে তা তেমন দাগ রাখেনি, কিন্তু আধুনিক বাংলা কাব্যই হোক আর গদ্যসাহিত্যের মোড় ঘোরাই হোক তা মূলত শুরু হয় তিরিশ ও চল্লিশ দশক থেকে। অন্য দিকে বলা যায়, সিনেমায় আধুনিক ভাষার সন্ধান শুরুই হল স্বাধীনতার মুহূর্তকে খেয়াল রেখে। এ এক আশ্চর্য সমাপতন যে সবান্ধব সত্যজিৎ রায় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাই করেছিলেন ১৯৪৭-এ। আর এ কথা আজ সকলেই জানেন যে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল শিল্পের পরিসরে সিনেমার প্রকৃত অবস্থান জানা ও জানানো।

Advertisement

কী ছিল আমাদের সিনেমা? মূলত যন্ত্রের বিন্যাসে চলচ্চিত্র কতটা সাহিত্যের গল্প বলতে পারছে, এই ছিল চলমান চিত্রমালার সাফল্যের নিরিখ। নিউ থিয়েটার্স এই ‘সাহিত্যিক’ ঐতিহ্য বুনে দিয়ে শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতেই সম্ভ্রম আদায় করেছিল। ছায়াছবির অস্তিত্ব অনেকটাই নির্ভর করে থাকত সংলাপের বিন্যাসে। আর কিছুটা গানেও। স্বাধীনতার পরেই এই নিশ্চিত স্রোতোধারা বিষয়ে সংশয় জাগল। ‘উদয়ের পথে’ যতই সামাজিক পট আলোকিত করুক তা যে নিশ্চিত দাওয়াই নয় এ কথা পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই জানা হয়ে গেল যখন নিমাই ঘোষ ‘ছিন্নমূল’ ছবিটি রচনা করলেন। আজ ‘ছিন্নমূল’কে আমরা এই জন্যই শুধু গুরুত্ব দিই না যে তা দেশবিভাগ সম্পর্কে একটি বাস্তব দলিল, কিন্তু আরও জরুরি যে নিমাই ঘোষের ক্যামেরা উদ্বাস্তু জীবন সম্পর্কে এক অভূতপূর্ব সত্যের সাক্ষর রেখেছিল অত্যন্ত আর্থিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেও। এই প্রথম অভিনয় প্রশিক্ষিত মানুষজনের সাহায্য ছাড়া প্রায় অপেশাদার নাট্যকর্মীদের নিয়ে নিমাই ঘোষ ১০ হাজার ফুটের এক সেলুলয়েড ইতিহাস লিখতে পারলেন যা এমনকী পুদভকিনের মতো বিরাট মাপের চলচ্চিত্র স্রষ্টাকে মুগ্ধ করে দেয়। সত্যজিৎ রায়ের আবির্ভাব তো প্রায় ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’। ‘পথের পাঁচালি’ কোনও গল্পই তেমন ভাবে বলেনি। বাংলা ছায়াছবির ঐতিহ্যের বিরুদ্ধাচরণ করে সত্যজিৎ রায় খুবই অল্প সংলাপের এই ছবি বানিয়েছিলেন যেখানে দৃশ্য স্বয়ম্ভর হয়ে উঠেছে। আপাত ভাবে গান কোনও নিশ্চিত উপকরণ হিসেবে কাজ করেনি। ভেবে দেখলে দেখা যাবে, অপুর কাহিনি তিনটির মধ্য দিয়ে একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজে এক জন নাগরিকের সম্ভাব্য গতিপথ অনুমান করেছেন সত্যজিৎ রায়। ‘অপরাজিত’ এক ভাবে দেখলে বঙ্গীয় আলোকায়ন সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। ‘অপুর সংসার’-এ যখন প্রেক্ষাগৃহে পৌরাণিক স্পেক্টাকেলের সামনে অপলক নায়িকার সঙ্গে এক্কা গাড়ির ডিজলভ জুড়ে দেওয়া হয় তখন আমাদের সন্দেহ থাকে না যে দৈবতাড়িত ভারতীয় সমাজ ক্রমশ ব্যক্তির নিজস্ব পরিসরের মধ্যে মুক্তির আলোকরেখা খুঁজে পেয়েছে। এই প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র সন্দর্ভধর্মী হয়ে উঠল। ঋত্বিক কুমার ঘটক ‘অযান্ত্রিক’ নামের যে ছবিটি তৈরি করেছিলেন তা-ও সাহিত্যে যা নিজস্ব অধিকার তার সঙ্গে সরাসরি একধরনের সংলাপে লিপ্ত। উপজাতীয় সমাজ কী ভাবে মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রার সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করতে পারে, এক ধরনের ব্যাপ্ত ইতিহাস চেতনা যা স্বাধীনতার আগে আমাদের ছবিতে কেউ ভাবতেও চাইত না, তা আমাদের চেতনায় মুদ্রিত হল।

এই যে এক ধরনের অন্তর্গত তাড়না যে ইমেজ নিজেই গল্পের থেকে প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, সে নিজেই ইতিহাস বা দর্শনের মতো করে যে কোনও পাণ্ডুলিপি রচনা করতে পারবে, স্বাধীনতার নবীন প্রভাত এ রকম একটা প্রতিশ্রুতি রেখেছিল। পাঠশালায় যাওয়ার জন্য অপু যে দিন চোখ মেলল, আমাদের সিনেমা দেখার চোখও সে দিনই প্রথম আলো খুঁজে পেল। এই ‘অপরাজিত’ ছবিতে লীলা চরিত্রটি বাদ পড়েছে, দেখা যাবে সেই সুযোগে সত্যজিৎ রায় শহরের সঙ্গে নাগরিকের সমীকরণের একটি নতুন চেহারা নিবেদন করেছেন যা অক্ষরে অক্ষরে আধুনিকতাবাদের এক ইস্তেহার। এমনকী, কারিগরি বিদ্যাতেও এই স্বাধীনতার স্পৃহা কাজ করেছিল। সুব্রত মিত্র যে বাউন্সড লাইটিং ‘অপরাজিত’-তে আবিষ্কার করেন তা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ইতিহাসে আমাদের গৌরব।

Advertisement

সত্যজিৎ রায় প্রথম বিশেষ ভাবেই চলচ্চিত্রশিল্পী যিনি সাহিত্য বা নাটকের সঙ্গে তার মাধ্যমকে মিলিয়ে ফেললেন না। তার ইমেজ সরস্বতীর দয়ায় কথা কয়ে উঠল। যেমন ঋত্বিক ঘটক হয়তো ব্যবহার করছিলেন গল্প কিন্তু নিসর্গ ও সম্প্রসারিত ইতিহাস তার সূত্রে আধুনিকতা বিষয়ক আমাদের ধারণাকে পুনরায় বিচার্য ভাবে। রবীন্দ্রনাথ একদা সিনেমা প্রসঙ্গে আক্ষেপ করেছিলেন, “রূপের চলৎপ্রবাহ কেন একটি স্বতন্ত্র রসসৃষ্টি রূপে উন্মেষিত হবে না?” আধুনিক বাঙালি কবি সুধীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্রকে ঠাট্টা করেছিলেন ‘জীবনের দ্বিরায়তনিক অনুকৃতি।/নিঃসাড় ছায়ার ছায়া...’। বিষ্ণু দে ঈষৎ বিদ্রূপের ছলে লিখেছিলেন, ‘কলম্বস- আবিষ্কৃতা, বিদেশিনী মহাশ্বেতা, স্নানসজ্জা বাহু আর কদলী দলিত উরু বৃথাই নাড়ালে!’

স্বাধীনতা-উত্তর যুগে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও তাঁদের সহকর্মীরা চলচ্চিত্র ভাষার স্বরূপ খুঁজে পান। আর সে উপলব্ধি তারা বিনোদনের অতিরিক্ত মুদ্রা হিসেবে প্রয়োগ করেন। এই স্বাধীনতাই তো মাধ্যমের স্বাধীনতা। এমনকী, পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকেই যে বাঙালি তাদের নায়ক নির্বাচন করল উত্তমকুমারকে যিনি সব অর্থেই আভিজাত্য বর্জিত এক আটপৌরে বাঙালি, তা-ও প্রমাণ করে স্বাধীন ভাবেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সিনেমা মাটির ঘর হতে পারে কিন্তু তাতে চাঁদ ওঠে। সেই চন্দ্রালোক হয়তো সত্যজিৎ-ঋত্বিক, নয়তো উত্তম-সুচিত্রা, সে ভাষা ব্যবস্থাই হোক আর নক্ষত্র বিন্যাসই হোক, সবই স্বাধীনতা পরবর্তী স্বাধীনতার স্বাদ।

(লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন