শব্দ-দাপটে কানের ক্ষতি, প্রভাব পড়ে হার্টেও। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
বিধি উড়িয়ে কালীপুজোর দিন তিনেক আগেই কলকাতায় শব্দবাজির তাণ্ডব দেখা গিয়েছে। শব্দবাজির দৌরাত্ম্যে যে কোনও ভাবেই লাগাম পরানো যাচ্ছে না, তা একপ্রকার স্পষ্ট। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত তো বটেই, দিনের বেলাতেও বাজি ফাটছে যত্রতত্র। শহর থেকে শহরতলি, বাজির দাপটে ঝালাপালা কান। শহরের একাধিক চিকিৎসকের অভিজ্ঞতাও বলছে, কালীপুজো পেরোতেই চেম্বারে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। জেরবার হতে হয় কান ও গলার সমস্যার রোগীদের নিয়ে। তার উপর কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানির রোগীরা তো রয়েছেনই। আতসবাজির ধোঁয়ার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে শব্দবাজির উৎপাত। আর তাতে শুধু যে কানের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, প্রভাব পড়ছে হার্টেও।
শহর থেকে শহরতলি, শব্দের তাণ্ডব কোথাও কম নেই। শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট ডেসিবেল না ছাড়ানোর বিজ্ঞপ্তি থাকলেও, সব ক্ষেত্রে এই নিয়ম মেনে চলার ছবি দেখা যায় না। বরং শব্দের মাত্রা ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। হৃদ্রোগ কিংবা সিওপিডি-র রোগীদের ক্ষেত্রে এই শব্দ কতটা মারাত্মক হতে পারে, তা কল্পনার বাইরে। চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারের মতে, মাইগ্রেন থাকলে এই ধরনের শব্দে কষ্ট আরও বাড়তে পারে। অনেকের অল্প আওয়াজেই মাথা ধরে যায়। সেখানে জোরে গান কিংবা বাজির তীব্র শব্দে অসুস্থতা যে কী মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে তা বলে বোঝানোর নয়। হার্টের সমস্যা কিংবা অ্যাংজ়াইটি অ্যাটাকের প্রবণতা থাকলে, শব্দ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাই যাঁদের এই ধরনের অসুস্থতা রয়েছে, তাঁদের এই শব্দ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা জরুরি। অনেক সময় দরজা-জানলা বন্ধ করেও শব্দ আটকানো যায় না। সে ক্ষেত্রে খুব সমস্যা হলে এমন কোনও জায়গায় এই সময়টিতে থাকা উচিত, যেখানে শব্দের দাপট কম।
শব্দবাজি আদতে দু’ভাবে কানের ক্ষতি করে থাকে। প্রথমত, শ্রবণযন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। দ্বিতীয়ত, শব্দবাজির ধোঁয়া থেকে নাক ও গলা জ্বালা হতে পারে। এ ছাড়া, শ্বাসকষ্টের ব্যাপার তো রয়েছেই। এই বিষয়ে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের ইএনটি এবং হেড-নেক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক-অধ্যাপক প্রণবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “ অন্তঃকর্ণের দু’টি প্রধান অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়— ককলিয়া (শ্রবণের জন্য) এবং ভেস্টিবুলার সিস্টেম (ভারসাম্য বজায় রাখে)। ককলিয়ার মধ্যে থাকা অতি সূক্ষ্ম ও সংবেদনশীল কোষগুলি তীব্র শব্দে নষ্ট হতে থাকে। এই কোষগুলির কাজ হল শব্দতরঙ্গকে বৈদ্যুতিক সঙ্কেতে রূপান্তরিত করে মস্তিষ্কে পাঠানো। কোষগুলি এক বার নষ্ট হলে তার পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া খুব জটিল, সাধারণত হয় না। ফলে চিরস্থায়ী বধিরতার সমস্যা দেখা দেয়।’’
কানের কাছে দু’-এক বার চকোলেট বোমা ফাটলে যে কেউ বধির হয়ে যাবেন, তা নয়। তবে তীব্র শব্দ যদি রোজ বা একটানা অনেক ক্ষণ ধরে শুনতে থাকেন, তা হলে তার প্রভাব পড়বে। কানের ভেস্টিবুলার সিস্টেমের যদি ক্ষতি হয়, তা হলে শরীরের ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে। তখন মাথা ঘোরা, ভার্টিগোর মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কানের কী ক্ষতি হয়?
১) ‘টেম্পোরারি থ্রেশহোল্ড শিফ্ট’, অর্থাৎ কম সময়ের জন্য কানে শুনতে না পাওয়া অথবা কান ভোঁ-ভোঁ করা। আচমকা তীব্র শব্দে বাজি ফাটলে অথবা জোরালো শব্দ শুনলে কিছু ক্ষণের জন্য মনে হতে পারে কানে কম শুনছেন। এই সমস্যা এক দিনেই ঠিক হয়ে যেতে পারে।
২) ‘পার্মানেন্ট থ্রেশহোল্ড শিফ্ট’, যাতে পাকাপাকি ভাবে কানের ক্ষতি হয়। বধিরতা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে। দীপাবলির পরে এমন সমস্যা নিয়েও অনেকে আসেন।
তীব্র শব্দে যে বিরক্তি আসে অথবা শরীরে কষ্ট হয়, তারও কারণ আছে। চিকিৎসকের ব্যাখ্যা, আজকাল সারা ক্ষণ কানে হেডফোন বা ইয়ারফোন গুঁজে থাকার অভ্যাস আছে অনেকেরই। উচ্চস্বরে কানে আওয়াজ নিতে নিতে কখন যে কান ও মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়, তা বুঝতেই পারেন না তাঁরা। এর উপর হঠাৎ করেই শব্দবাজির তীব্র আওয়াজ কানে গেলে তখন নানাবিধ সমস্যা শুরু হয়। কানে কম শোনা, মাথা যন্ত্রণা, বুক ধড়ফড় করা, এমনকি মানসিক সমস্যাও হতে পারে। তীব্র শব্দের প্রভাব পড়ে হার্টেও। এতে হৃৎস্পন্দনের গতি অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে।
নাগাড়ে শব্দবাজির আওয়াজে শিশুদের ক্ষেত্রে প্যানিক ডিজ়অর্ডার দেখা যেতে পারে। বাজির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে শিশুদের খিদে কমে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অস্থির হয়ে উঠতে পারে ছোটরা। গর্ভস্থ ভ্রূণের ক্ষেত্রেও শব্দবাজির দাপট ক্ষতি করতে পারে বলেও জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। এতে অন্তঃসত্ত্বাদের উত্তেজনা বৃদ্ধি, রক্তচাপ বৃদ্ধি, ঘুম নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
তাই সচেতন ভাবেই শব্দবাজি না ফাটানোই উচিত। কলকাতায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনও সরু রাস্তায় বা গলির মধ্যে ক্রমাগত শব্দবাজি ফাটানো হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ওই শব্দতরঙ্গ আশপাশের বাড়ির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে সজোরে কানের উপর এসে পড়ে। তাতে ক্ষতির আশঙ্কা আরও বাড়ে। বাড়িতে শিশু বা বয়স্করা থাকলে দরজা-জানলা ভাল করে বন্ধ রাখলে ভাল হয়, যাতে তীব্র আওয়াজ ভিতরে না আসে। প্রয়োজনে ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে নিন কানে। এর পরেও কম শুনলে বা কানের ভিতরে ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করবেন না।