Choddo Shak

ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি কি শুধুই ধর্মীয়? রয়েছে অন্য কারণও, স্বাস্থ্যগুণ কেমন শাকগুলির

ভূত চতুর্দশীর দুপুরে চোদ্দো শাক খাওয়া আর সন্ধ্যাবেলায় চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানো এবং দরজায় চোদ্দোফোঁটা দেওয়ার রেওয়াজ আজও চলে আসছে। কেন চোদ্দ শাক খাওয়া রীতি? কারণ কি শুধুই প্রচলিত বিশ্বাস?

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০০
Share:

ভূত চতুর্দশীর দিন কেন চোদ্দো শাক খাওয়া হয়? ফাইল চিত্র।

দ্রৌপদীর হাতে শাকান্ন খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। তাতেই পেট ভরেছিল ঋষি দুর্বাসার। আর সে যাত্রায় ঋষির ক্রোধ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন পাণ্ডবেরা। সংস্কৃত সাহিত্যে শাকের মাহাত্ম্য তেমন উল্লিখিত না থাকলেও, আঞ্চলিক সাহিত্যে শাকের গুণ গেয়েছেন অনেকেই। নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালির ইতিহাস’-এ প্রাচীন কালে বাঙালির খাওয়াদাওয়ার বিবরণ দিয়ে গিয়ে শাক-ভাতের প্রসঙ্গই এসেছে। দীর্ঘ সময় ধরে গ্রামের গরিব লোকেদের প্রধান খাবারই ছিল শাক আর নানা সব্জি। তবে পুজোর ভোগেও শাক দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। কিন্তু কালীপুজোর সঙ্গে চোদ্দো শাকের সম্পর্ক কবে থেকে তৈরি হল তার স্পষ্ট হিসেব নেই। কালীপুজোর আগের দিন চোদ্দো শাক খেয়ে চোদ্দো প্রদীপ জ্বালিয়েই ভূত চতুর্দশী পালন করার রেওয়াজ বহু প্রাচীন সময় থেকেই চলে আসছে। বাড়ির বড়রা বলতেন, এ দিনে নাকি মা কালীর পার্শ্বচরেরা ধরাধামে অন্ধকারের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। কথিত, যে বাড়িতে চোদ্দো শাক খাওয়া হয় না বা চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানো হয় না, সেখানেই নাকি সেই বিশেষ অন্ধকার নামে। ভূত চতুর্দশীর দুপুরে চোদ্দো শাক খাওয়া আর সন্ধ্যাবেলায় চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানো এবং দরজায় চোদ্দো ফোঁটা দেওয়ার রেওয়াজ আজও চলে আসছে।

Advertisement

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, শস্যদায়িনী প্রকৃতির সঙ্গে এর যোগ রয়েছে। আদ্যাশক্তি তো প্রকৃতির মধ্যেই থাকেন। শাক, লতাপাতার মধ্যেই তাঁর শক্তির আধার। তাই পুরাণ মেনেই চোদ্দ শাক খাওয়ার রীতি রয়েছে। তাই তাঁর আর এক নাম 'শাকম্ভরী'। পুষ্টিবিদেরা বলেন, চোদ্দো শাক খাওয়ার সঙ্গে শরীর-স্বাস্থ্যের যোগই বেশি। চোদ্দো রকম শাক ভেষজ গুণসম্পন্ন, নানা রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। আসলে, ঋতু বদলের সময়ে নানা রোগ ছড়ায়। সেকালে তো আর অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যেত না, ভেষজ উপাদানেই চিকিৎসা করা হত। এই চোদ্দো রকম শাক রোগ প্রতিরোধে অব্যর্থ। শাকের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট রয়েছে, যা জীবাণু প্রতিরোধী। তাই স্বাস্থ্যগুণের বিচারেই চোদ্দো শাক খাওয়া খুবই উপকারী।

চোদ্দো রকম শাক স্বাস্থ্যগুণে সমৃদ্ধ। ছবি: ফ্রিপিক।

চোদ্দো শাক খাওয়া এখন হয়তো শুধু নিয়ম বা রীতি হয়ে উঠেছে, কিন্তু এক সময়ে এই প্রথাকে ঘিরেই আনন্দ ভাগ করে নিতেন বাড়ির মহিলারা। চার দেওয়ালের চৌহদ্দিতে হেঁশেল ঠেলতে ঠেলতেই যাঁদের দিন কাটত, তাঁদের কাছে এই চোদ্দো শাক রান্নার দিন ছিল হইহুল্লোড়ের দিন। চোদ্দো রকম শাক বেছে কেনা, শাক কুটতে কুটতে গল্পগাছা করা, একসঙ্গে রান্না করে খাওয়া— সব মিলিয়ে উৎসব পরিপূর্ণতা পেত। এখন তো চোদ্দো রকম শাক বাজারে পাওয়াই যায় না। চোদ্দো শাক বলতে যে শাকগুলির নাম জানা যায়, যেমন— ওল, কেও, বেতো, কালকাসুন্দে, নিম, সর্ষে, শালিঞ্চে, জয়ন্তী, গুলঞ্চ, পলতা, ভাঁট, হিঞ্চে বা হেলেঞ্চা, শুষনি ও শৌলক বা শুলকা শাকের সব ক’টি এখন পাওয়া যায় না। বাজারে চোদ্দো শাক বলে যে আঁটি বিক্রি হয়, তাতে চার থেকে পাঁচ রকম শাক থাকে মাত্র। তবে এখন যে সব শাক পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছে

Advertisement

পালং, লালশাক, নিম, মেথি, পাটশাক, ঘেঁটুশাক, পুঁই, কুমড়ো, কলমি, সর্ষে, বেতো, হিঞ্চে, শুষনি, পলতা। স্থানভেদে এর হেরফেরও ঘটে। তবে যেগুলির নাম এখানে করা হল, তাদের স্বাস্থ্যগুণও কম নয়।

পুঁইশাক ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা নেয়। ভিটামিন বি৬ ও ফলিক অ্যাসিড থাকায় রক্তল্পতার সমস্যাও দূর করে। এই শাক খেলে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রাও কমে।

পালংশাক ভিটামিন সমৃদ্ধ। তা ছাড়া প্রোটিন, ক্যালশিয়াম, আয়রন, জ়িঙ্ক থাকায় হাড়ের স্বাস্থ্য ভাল রাখে। পালং খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, দৃষ্টিশক্তি ভাল হয়। ওজন কমাতেও উপকারী পালং শাক।

লালশাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই থাকে, যা চোখের জন্য খুব ভাল। অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টে ভরপুর লালশাকে ভিটামিন সি, বি১, আয়রন ও ফাইবারও রয়েছে যথেষ্ট পরিমাণে।

মেথি শাক ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। হার্টের জন্যও ভাল। অম্বলের সমস্যা কমাতে বিশেষ ভাবে উপযোগী এটি।

পাটশাক পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, সেলেনিয়াম ও ভিটামিন এ, ই, সি, কে সমৃদ্ধ। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, হজমশক্তি উন্নত করতে, রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে, এবং ত্বকের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সাহায্য করে।

নিমপাতা জীবাণু প্রতিরোধী। কুষ্ঠ, যে কোন চর্মরোগ, জণ্ডিস, ডায়াবিটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।

তেতো নয় বলে চোদ্দো শাকের মধ্যে বেশি করে সর্ষে শাক রাখা হয়। পেট পরিষ্কার করে। বিটা ক্যারোটিন থাকায় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের কাজ করে। এটি ত্বক, লিভার, চোখের পক্ষেও উপকারী।

বেতোশাক আগাছার মতো জন্মায়। পাতা আর কচি ডগা খাওয়া হয়। প্রচুর পরিমাণে জৈব অ্যাসিড থাকে। কৃমিনাশক এই শাক কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্বলও সারায়। পেপটিক আলসারে শাক খাওয়া বারণ হলেও বেতো শাক খাওয়া যায়।

শুষনিশাক অনিদ্রাজনিত সমস্যার সমাধান করে। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক অস্থিরতা কমায়। এই শাক স্মৃতিবর্ধক।

হিঞ্চে খেলে পিত্তনাশ হয়। এর পাতা এবং কচি ডগা খাওয়া হয়। এতে থাকে ফাইটোস্টেরল-সহ বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক। যা রক্তশোধন করে। হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়। এটি ক্ষুধাবর্ধক। জ্বর সারায়।

ফ্ল্যাভনয়েড সমৃদ্ধ হওয়ায় ঘেঁটুশাক ক্যানসার প্রতিরোধী। তা ছাড়া কোলেস্টেরল, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক।

পলতা আসলে পটলপাতা। চোদ্দো শাকের মধ্যে অনেক সময়েই মেশানো থাকে। এতে বিভিন্ন ফ্যাটি অ্যাসিড, জৈব আসিড, খনিজ লবণ প্রচুর পরিমাণে থাকে। লিভারের জন্য খুবই ভাল এই শাক।

গুলঞ্চের স্বাস্থ্যগুণ অনেক। বাত, রক্তচাপ, এগ্জ়িমা, জন্ডিস সারায়। পরিপাকে সাহায্য করে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement