প্রতীকী চিত্র। — ফাইল চিত্র।
বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো মানে বছরের সেরা পাঁচটি দিন। সেরা সময়ে কাছের মানুষদের কাছে নিজেকেও তো সেরা ভাবেই মেলে ধরতে হবে। সারা বছর দেহের ওজন নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও তাই পুজো যত এগিয়ে আসে, ততই ফিটনেস নিয়ে খুঁতখুঁতে মনোভাব তৈরি হয়।
বছরের এই সময়টায় শহরের জিমগুলিতে ‘পরিযায়ী’দের ভিড় বাড়ে। সারা বছর এই দলটির দেখাসাক্ষাৎ মেলে না। কিন্তু পুজোর এক-দেড় মাস আগে থেকে তাঁরা জিম শুরু করেন। লক্ষ্য একটাই, পুজোয় রোগা হতে হবে। ভাল ভাবনা। কিন্তু এক মাসে হঠাৎ করে জিমে ভর্তি হয়ে ওজন কমানো কি সম্ভব? আর যদি তা সম্ভব হয়, তা হলে সেই পদ্ধতি কতটা নিরাপদ?
এক মাসে শরীরচর্চার মাধ্যমে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি কতটা ওজন কমাতে পারবেন, তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। কারণ ওজন কমানো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিএমআই, মেটাবলিজ়ম, ডায়েট, ক্লান্তি, ঘুমের ধরন-সহ একাধিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। ফিটনেস প্রশিক্ষক অনুপ আচার্য বললেন, ‘‘জিমের সিংহভাগ প্রশিক্ষক বলে দেন যে, ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী ওজন কমে যাবে। কিন্তু জিমে মাসে ৪ কেজি থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত ওজন কমানো যেতে পারে। তা-ও ৫ কেজি কমানোও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।’’
প্রতীকী চিত্র। ছবি: এআই।
অনুপ জানালেন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং মহিলাদের প্রতি দিন গড়ে যথাক্রমে ১ হাজার ৫০০ কিলোক্যালোরি এবং ১ হাজার ২০০ কিলোক্যালোরির প্রয়োজন হয়। তাঁর কথায়, ‘‘সহজ ভাবে বলতে গেলে ১ গ্রাম ফ্যাট কমানোর অর্থে ৯ ক্যালোরি ঝরছে। তার মানে ১ কেজি ফ্যাট গলাতে ব্যক্তিকে ৭ হাজার ৭০০ ক্যালোরি ঝরাতে হবে। সেটা তো বেশ কঠিন কাজ!’’ একই সঙ্গে অনুপ জানালেন, বাড়তি ক্যালোরি কমানোর জন্য ডায়েট এবং শরীরচর্চাকে একযোগে ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।
এই ভাবে হঠাৎ করে জিমে গিয়ে রোগা হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থেকে যে দেহে চোট-আঘাতের আশঙ্কা বৃদ্ধি পেতে পারে, সে দিকেই নির্দেশ করলেন চিকিৎসক একে পাল। তাঁর মতে, পেশিকে পরিস্থিতির সঙ্গে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে হয়। রেজ়িস্ট্যান্ট ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তা সম্ভব। তাঁর কথায়, ‘‘এক ধাক্কায় পাহাড়ে ওঠা সম্ভব নয়। আগে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। তাই হঠাৎ করে অতিরিক্ত শরীরচর্চায় বড় চোটের সম্ভাবনা তৈরি হয়।’’
প্রতীকী চিত্র। ছবি: এআই।
এই ভাবে শরীরচর্চার ফলে মূলত দু’রকমের চোটের দিকে নির্দেশ করলেন তিনি। ‘মাস্ল টিয়ার’ এবং ‘লিগামেন্ট ইনজুরি’। প্রথমটির ক্ষেত্রে বেশি ওজন বা ভুল ভঙ্গিতে ব্যায়ামের ফলে পেশি ছিঁড়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি খারাপ হলে মাস্ল বেলি এবং টেনডনের সন্ধিস্থলে বড় চোট লাগতে পারে। সেই চোটে যদি ফাইব্রাস টিস্যু তৈরি হয়, তখন পেশির সঙ্কোচন-প্রসারণ আর সম্ভব হয় না। এ ছাড়াও হঠাৎ করে বেশি ওজন-সহ ব্যায়াম করলে পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যেতে পারে। একে পাল বললেন, ‘‘চাপের ফলে কোনও এক দিকের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে ওই অস্থিসন্ধি তখন ভারসাম্য হারায়। তখন হাঁটতে গেলে ব্যথা শুরু হয়।’’
শহরের একটি জিমে নিয়মিত শরীরচর্চা করেন শিক্ষিকা পিঙ্কি বন্দ্যোপাধ্যায়। এক সময়ে তিনি স্থূলত্বের সমস্যায় ভুগতেন। কিন্তু গত এক বছরে নিয়মিত শরীরচর্চা করে ৫০ কেজি ওজন কমিয়েছেন। পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের কাছে এখন তিনি ফিটনেসের ‘অনুপ্রেরণা’। তবে পিঙ্কি কিন্তু রোগা হওয়ার জন্য কোনও শর্টকার্ট পন্থা নেননি। বললেন, ‘‘আমি চটজলদি কোনও ফলাফলে বিশ্বাসী নই। রোগা হওয়ার জার্নি শুরুর পর বুঝতে পারি, নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। সেই ভাবেই এক বছরে আমি সফল হয়েছি।’’
প্রতীকী চিত্র। ছবি: এআই।
ধরা যাক, তবুও কেউ ১ মাসের জন্য জিমে ভর্তি হয়েছেন। শরীরচর্চাও করছেন। তিনি কী ধরনের ফলাফল আশা করতে পারেন? শহরের একটি প্রথম সারির জিম চেনের সিনিয়র ফিটনেস প্রশিক্ষক রাহুল রায়ের মতে, সুরক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এক মাস শরীরচর্চা করলে ওজন কমতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে দেহে খুব বেশি ট্রান্সফরমেশন দেখা যাবে না। রাহুল বললেন, ‘‘কিন্তু এই এক মাসে কারও মেটাবলিজ়ম ভাল হতে পারে। কেউ কেউ শরীরে আগের তুলনায় বেশি এনার্জি অনুভব করতে পারেন।’’ স্বল্প সময় শরীরচর্চার ফলে শরীর একটু সুঠাম দেখাতে পারে। বেশি ওজন-সহ ব্যয়ামের ফলে মেদও কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু বেশি মাত্রায় মেদ কমানো বা ফিট হওয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদি কোনও পদ্ধতিতে সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। রাহুলের পরামর্শ, ‘‘পুজোর আগে কষ্টের ফল পুজোর দিনে খাওয়াদাওয়াই নষ্ট করে দেয়। তাই পুজোর পরেও যদি কেউ জিম না করেন, তা হলে সুঠাম শরীর বজায় রাখা সম্ভব নয়।’’
পুজোর আগে জিমে ভর্তি হওয়াই যায়। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রশিক্ষকের অধীনে শরীরচর্চা করা উচিত। তার ফলে চোট-আঘাতের ঝুঁকি কমবে। অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরচর্চা না করাই ভাল। আর পুজোর লক্ষ্য মাথায় রেখে শরীরচর্চা শুরু করলে, সেই অভ্যাস যাতে আগামী দিনেও বজায় থাকে, সে দিকে খেয়াল রাখা উচিত।