US Tariff on India

২৫-এ তাও আশা ছিল, কিন্তু ৫০! ট্রাম্প-শুল্কের প্রভাব শুরু, ভারতের বরাত বাতিল করে দুই দেশের দিকে ঝুঁকছেন ক্রেতারা

ভারতের জুতো ও চামড়াজাত পণ্যের অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্র আগরা। ডোনাল্ড ট্রাম্প ৫০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করার পর সেখানকার ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। দাবি, এ ভাবে চললে কোনও দেশের সঙ্গেই চামড়ার ব্যবসায় আর পেরে উঠবেন না তাঁরা।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৯
Share:

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার প্রভাব ভারতের চামড়ার বাজারে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

ভারতীয় পণ্যে যখন ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তখনও আশা ছিল। কিন্তু শুল্ক দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আর আশা দেখতে পাচ্ছেন না আগরার ব্যবসায়ীরা। সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে জুতো এবং অন্যান্য চামড়াজাত দ্রব্য প্রতি বছর বিদেশে রফতানি করা হয়। ক্রেতাদের মধ্যে অন্যতম আমেরিকা। কিন্তু ট্রাম্পের ঘোষণার পর থেকে আগরার ব্যবসায়ীরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। দাবি, এ ভাবে চললে কোনও দেশের সঙ্গেই চামড়ার ব্যবসায় আর পেরে উঠবেন না তাঁরা। এমনকি, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়াও ভারতকে ছাপিয়ে যাবে।

Advertisement

কলকাতা, চেন্নাই, কানপুরের পাশাপাশি আগরাও ভারতের জুতো ও চামড়াজাত পণ্যের অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্র। এখানে এই ধরনের পণ্যের হাজার দশেক মাইক্রো-ইউনিট রয়েছে। এ ছাড়া, চামড়ার ১৫০টি ক্ষুদ্র, ৩০টি মাঝারি এবং ১৫টি বৃহৎশিল্প রয়েছে। চামড়ার কাঁচামাল মূলত কানপুর এবং চেন্নাই থেকে আসে। এ ছাড়া, তুরস্ক থেকেও চামড়া আমদানি করা হয়, স্থলপথে যা ভারতে পৌঁছোতে ৪৫ থেকে ৫০ দিন লাগে। আগরায় চামড়ার কাজে নিযুক্ত এক লক্ষেরও বেশি মানুষ। এত দিন চামড়ার জিনিসের উপর রফতানি শুল্ক দিতে হত মাত্র পাঁচ থেকে আট শতাংশ। এক ধাক্কায় তা ২৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। এতে তবু কাজ চলছিল। কিন্তু তার পর ভারতের পণ্যে মোট ৫০ শতাংশ শুল্কের কথা বলেছেন ট্রাম্প। ২৭ অগস্ট থেকে যা কার্যকর হওয়ার কথা।

আগরার চামড়ার পণ্যের প্রধান বাজার কিন্তু আমেরিকায় নয়, ইউরোপে। তবে আমেরিকায় সবেমাত্র বাণিজ্য বিস্তার করতে শুরু করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। শেষ চার মাসে এখানকার মোট রফতানির প্রায় অর্ধেকই গিয়েছে আমেরিকায়। বিক্রি হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পণ্য। আমেরিকার বাজারে ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠছে দেখে বহু বিনিয়োগকারী হাত উপুড় করে দিয়েছিলেন। আচমকা শুল্ক-ঘোষণায় তাঁদেরও মাথায় হাত।

Advertisement

তেজ ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডে দিনে ১৫ হাজার জোড়া জুতো তৈরি হয়। এখানে কাজ করেন প্রায় চার হাজার মানুষ। বছরে ১২ লক্ষ জোড়া জুতো এই সংস্থা বিদেশে রফতানি করে। সংস্থার কর্ণধার সুশান্ত ধাপোড়কার বলেন, ‘‘শুল্কের প্রভাব তো পড়বেই। আমাদের আগরা থেকে জুতো এবং চামড়ার জিনিসপত্র সাধারণত ইউরোপে যায়। আমেরিকার খরিদ্দার মাত্র তিনটি। আমরা আমেরিকার বাজারে ঢোকার চেষ্টা করছিলাম। ওটা বিশাল একটা বাজার। এক বার ঢুকতে পারলে আমাদের ব্যবসা বদলে যেত। কিন্তু শুল্কের ফলে আমেরিকার বাজারে আমাদের অগ্রগতি অনেকটা ধাক্কা খেল।’’

আগরা জুতো উৎপাদন ও রফতানি চেম্বারের প্রেসিডেন্ট এবং ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল ফর ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদার ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারম্যান পূরণ দাওয়ার বলেন, ‘‘আমেরিকার বাজার ধরতে আমরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। যাঁরা আগে ছ’টি বিধানসভা এলাকায় কাজ করছিলেন, এখন তাঁরা ১৪টিতে কাজ করছেন। আগের চেয়ে বড় ইউনিটও খুলে ফেলেছিলাম আমরা। কিন্তু এখন আর তাতে লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’’

শরৎ থেকে শীতকাল পর্যন্ত আগরার জুতো তৈরির কারখানাগুলিতে দম ফেলার সময় থাকে না। এটা ব্যস্ততম মরসুম। আমেরিকা থেকে এই সময় প্রচুর বরাত আসে। চাম়়ড়ার বুট থেকে শুরু করে লম্বা পোশাক, উৎপাদনের গতি এই সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বেড়ে যায়। অধিকাংশ বরাতের কাজই শেষ হয়ে গিয়েছে। রফতানির জন্য পণ্য তৈরি। কিন্তু শেষ মুহর্তে ক্রেতাদের ফোন আসছে। বরাত স্থগিত করে দেওয়া হচ্ছে।

উৎপাদনকারীদের মতে, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর মার্কিন ক্রেতারা ইতিমধ্যে ভারতের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। অনেকে চিনের দিকে ঝুঁকছেন। উঠে আসছে ভিয়েতনামের নামও। এই দুই দেশের উপর মার্কিন শুল্ক এখনও বেশ কম। দাওয়ার বলেন, ‘‘শীতের অর্ডারের জন্য এটাই তো সিজ়ন। কিন্তু ক্রেতারা আমাদের অর্ডার স্থগিত করে দিচ্ছেন। মাল তৈরি হয়ে পড়ে আছে, আমরা পাঠাতে পারছি না। ওঁরা চান, শুল্কের কারণে যে ক্ষতি হবে, আমরাও তার ভাগ নিই। কিন্তু আমেরিকার বাজার খুব সংবেদনশীল। সাড়ে ১২ শতাংশের ক্ষতির বোঝাও কেউ বইতে পারেন না। সেখানে ৫০ শতাংশ তো দূরের কথা।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কেউ কেউ তো অর্ডার বাতিল করে চিনের দিকে চেয়ে আছেন। সেখানে শুল্ক ৩০ শতাংশ। ভিয়েতনামে ২০ শতাংশ। ওদের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় পারব না।’’

চড়া মার্কিন শুল্কের ফলে শুধু যে ভারতের বাজার মার খাবে, তা নয়। অনেকের মতে, এর ফলে আমেরিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ শুল্ক যত বেশি হবে, মার্কিন পণ্য তত দামি হবে। উৎপাদকদের একাংশের আশঙ্কা, এ ভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে কারখানা বন্ধ করে দিতে হবে। বরাত না এলে কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। তখন অনেকের চাকরি যাবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও অনেকে আশাবাদী। তাঁরা মনে করছেন, এটা ট্রাম্পের কৌশল মাত্র। আমেরিকা এবং ভারত সরকারের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে সমঝোতা হবে এবং শুল্ক আগের অবস্থায় ফিরবে, আশা রাখছেন আগরার ব্যবসায়ীরা।

যাঁরা আমেরিকায় সরাসরি রফতানি করেন না, মার্কিন শুল্কে তাঁদের ব্যবসাও প্রভাবিত হচ্ছে। কানপুরের ট্যানারির মালিক নাসিম খান বলেন, ‘‘কাজ কতটা এগিয়েছে না দেখেই আমাদের ফোন করছে বলা হচ্ছে, এখনই কাজ বন্ধ করুন। আমরা সরাসরি আমেরিকায় রফতানি করি না। কিন্তু এর সঙ্গে আমরাও জড়িত। আমরা যে চামড়া উৎপাদন করি, সেটা তাঁরাই অনুমোদন করেন, যাঁরা আমেরিকার জন্য পণ্য প্রস্তুত করেন।’’

এই পরিস্থিতিতে ভারত থেকেও বিকল্পের খোঁজ চলছে। এক সময় আগরার চামড়াজাত পণ্যের রমরমা ছিল রাশিয়ার বাজারে। আবার সে দিকেই ঝোঁকা হবে কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। অনেকে আবার দেশীয় বাজারে মনোনিবেশ করতে চাইছেন। কাউন্সিল ফর লেদার এক্সপোর্টের চেয়ারম্যান রাজেন্দ্রকুমার জালান জানিয়েছেন, ট্রাম্প ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কথা বলার পর থেকেই ভারতের রফতানি আটকে। সব বরাত আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘শুল্ক যখন ২৫ শতাংশ ছিল, তাও কিছুটা আশা ছিল। আমাদের তখনও বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু এখন আমরা একেবারে ফ্রেমের বাইরে। চিন এতে অনেক বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে।’’

রাশিয়া থেকে খনিজ তেল এবং অস্ত্র কেনার কারণে ভারতের উপর বাড়তি শুল্ক চাপিয়েছে আমেরিকা। দাবি, ভারতের বাণিজ্যের টাকায় ইউক্রেনে যুদ্ধ চালাতে সুবিধা হচ্ছে রাশিয়ার। তবে ভারত সরকারের অবস্থান এখনও অনড়। রাশিয়া সস্তায় তেল বিক্রি করে। ভারতের বক্তব্য, জাতীয় স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক বাজারদরের কথা মাথায় রেখেই বাণিজ্যনীতি স্থির করা হয়। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার সঙ্গে সমঝোতা হবে কি না, সে দিকে চেয়ে আছেন ব্যবসায়ীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement