ভাবনগরের হাসপাতালে চিকিৎসক গণেশ বরইয়া। ছবি: সংগৃহীত।
শার্টের উপরে হাসপাতালের চেনা সাদা অ্যাপ্রন। গলায় ঝুলছে স্টেথোস্কোপ। চোখমুখে চাপা উত্তেজনা। গুজরাতের ভাবনগরের স্যর টি জেনারেল হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে রোগীকে নিয়ে স্ট্রেচার ঢুকতেই ছুটে গেলেন তিনি। নিজে রোগীকে দেখলেন না। দু’জন ইন্টার্নকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিলেন। তার পর ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
তত ক্ষণে অবশ্য রোগীর পরিজনদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি শুরু হয়ে গিয়েছে। খোদ ডাক্তারের মাথা যে স্ট্রেচার পর্যন্ত পৌঁছোচ্ছেই না! স্ট্রেচারের উচ্চতার চেয়েও ডাক্তারের উচ্চতা কম! রোগীর পরিজনদের সেই দ্বিধা, সংশয়কে পাত্তা না দিয়েই নিজের ঘরে ঢুকলেন গণেশ বরইয়া। বয়স ২৫, উচ্চতা ৩ ফুট এবং নামের পাশে এমবিবিএস। শরীরে ৭২ শতাংশ অক্ষমতা নিয়ে কিছু দিন আগেই এই ডিগ্রি লাভ করেছেন তিনি। নিরক্ষর কৃষক বাবার স্বপ্ন সফল করেছেন।
ভাবনগরের গোরখি গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম গণেশের। বাবা-মায়ের অষ্টম সন্তান, প্রথম পুত্র। শুরু থেকেই তাঁকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল পরিবার। কিন্তু জন্ম থেকে গণেশ বামন। গ্রোথ হরমোনের অভাবে চলাফেরাতেও সমস্যা হত বিস্তর। রোগ ধরা পড়ার পর তাঁকে ঘিরে পরিবারের আশা-ভরসা নিবে এসেছিল। তবে ভালবাসা কমেনি। ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে গণেশ জানান, ১০ বছর বয়সে তাঁকে ‘কিনে’ নিতে এসেছিলেন এক সার্কাসদলের কয়েক জন সদস্য। বাবাকে পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা। জানিয়ে দিয়েছিলেন, সার্কাসদলে কাজ ছাড়া গণেশের আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই, আর কোনও ভবিষ্যৎ হতে পারে না!
চেম্বারে কর্মরত গণেশ বরইয়া। ছবি: সংগৃহীত।
সে দিন সার্কাসদলকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন গণেশের বাবা। একমাত্র পুত্রকে হারানোর ভয় যেন জাঁকিয়ে বসেছিল। গণেশকে তিনি আর কাছছাড়া করতেন না। তাঁকে কোলে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন দিদিরা। মাথায় চড়াতেন বাবা। সে দিন থেকেই গণেশ বুঝে গিয়েছিলেন, অক্ষমতাকে সঙ্গী করে আগামীর পথে হাঁটতে হবে তাঁকে। উচ্চতা বাড়বে না, কিন্তু তাঁকে বড় হতে হবে। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নও কি দেখে ফেলেছিলেন সে দিনই? গণেশ বলেন, ‘‘চলার পথে অনেকের কাঁধ আমার দরকার হবে, বুঝে নিয়েছিলাম সেই ছোটবেলাতেই। অনেকে আমাকে সাহায্য করেছেন। সেটা ছাড়া এই পর্যন্ত আমি পৌঁছোতেই পারতাম না।’’
আপাতত ভাবনগর জেনারেল হাসপাতালের ‘বন্ডেড মেডিক্যাল অফিসার ক্লাস-২’ গণেশ। ২৬ নভেম্বর পেয়েছেন নিয়োগপত্র। অবলীলায় স্বীকার করলেন, এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না এই বাস্তবকে। কারণ, তিনি প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেছেন সাত বছর আগে, সেই ২০১৮ সালে। তার পরেও ডাক্তারি পড়তে পদে পদে বাধা এসেছে। সহজে কোথাও ভর্তিই হতে পারেননি। প্রথমে বাধা দিয়েছিল জাতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিল (এমসিআই)। বলা হয়েছিল, গণেশের শারীরিক অক্ষমতা ডাক্তার হওয়ার প্রতিবন্ধক। মামলা গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত।
গুজরাত হাই কোর্ট গণেশের আবেদনের বিপক্ষে রায় দেয়। জানিয়ে দেয়, মেডিক্যাল কাউন্সিলের ধারণা অমূলক নয়। এর পর গণেশ আর আশা রাখেননি। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে ইতি টেনে বাস্তবে মন দিয়েছিলেন। হাল ছেড়ে ভর্তি হয়েছিলেন বিএসসি পড়ার জন্য। কিন্তু এই সময় তাঁর পাশে দাঁড়ান তাঁর স্কুলের ডিরেক্টর চিকিৎসক দলপৎ কাটারিয়া। গণেশকে না জানিয়েই তিনি তাঁর মামলাটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান। শীর্ষ আদালত গণেশের পক্ষে রায় দেয় বছরখানেক পর। সেই থেকে চিকিৎসক কাটারিয়াকে মেন্টর মানেন গণেশ।
ডাক্তারি পড়ার ছাড়পত্র তো মিলল। ভাবনগর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিও হলেন গণেশ। কিন্তু ফের ধাক্কা। প্রথম সেমেস্টারের লিখিত পরীক্ষায় পাশই করতে পারলেন না তিনি। বাকিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেন। সময়ে শেষ হল না উত্তর লেখা। গণেশ বলেন, ‘‘দীর্ঘ উত্তরপত্র আর সময়ের সঙ্গে মানিয়ে উঠতে পারিনি আমি। বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু চিকিৎসক কাটারিয়া আমার সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলেন। আমাকে উত্তর লেখার জন্য রাইটার দেওয়া হয়। দেওয়া হয় বাড়তি এক ঘণ্টা সময়। এমবিবিএস-এর বাকি সেমেস্টারগুলিতে প্রথম সুযোগেই পাশ করেছি আমি। আর আটকাইনি। এর আগে কখনও এমবিবিএস-এ কাউকে রাইটার দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।’’ যাঁরা পাশে থেকেছেন, তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ গণেশ। বলেছেন, ‘‘আমি সাফল্য পেয়েছি, কারণ, বহু মানুষ আমার পাশে থেকেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাটারিয়া স্যর। তা ছাড়া, দাভে স্যর (চিকিৎসক যশ দাভে, গণেশের সিনিয়র) আমাকে আইনি লড়াইয়ে সাহায্য করেছেন। ডাক্তারি পড়তেও সাহায্য করেছেন।’’
সহপাঠীরা কেমন? ডাক্তারি পড়তে গিয়ে সহপাঠীদের দিক থেকে কোনও বাধা বা বিদ্রুপ এসেছে কি? এ ক্ষেত্রেও নিজের ভাগ্যের তারিফ করছেন গণেশ। জানিয়েছেন। সহপাঠীরা পদে পদে তাঁকে সাহায্য করেছেন। কখনও কেউ তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেননি। তাঁর কথায়, ‘‘সহপাঠী বন্ধুরা আমার জন্য সামনের দিকে জায়গা রেখে দিত, যাতে আমার নোট নিতে অসুবিধা না হয়। প্র্যাকটিক্যালের সময়েও বন্ধু এবং অধ্যাপকদের সাহায্য পেয়েছি। বিশেষত অ্যানাটমির প্র্যাকটিক্যালে আমার জন্য টেবিলের উপর আলাদা ব্যবস্থা করা হত। আলাদা টুল এনে দেওয়া হত। কখনও কখনও কেউ আমাকে কোলেও তুলে নিত।’’ এমনকি, গুজরাতি মিডিয়ামে পড়ে আসা গণেশকে ইংরেজিতেও সাহায্য করেছেন তাঁর সহপাঠীরা।
চেম্বারে স্টেথোস্কোপ গলায় বসে গণেশ বরইয়া। ছবি: সংগৃহীত।
গণেশের সঙ্গে ভাবনগরের ওই হাসপাতালে তাঁর দু’জন সহপাঠীও যোগ দিয়েছেন। তাঁর লড়াইয়ের গল্প বিভোর হয়ে শুনছিলেন চিকিৎসক দীপক ভাদের। এমবিবিএস-এর প্রথম বর্ষ থেকে তিনি গণেশের রুমমেট। তিনি বললেন, ‘‘এমবিবিএস-এর ক্লাসে প্রথম যখন গণেশ এল, আমরা ভাবছিলাম, এই বাচ্চাটা কে! ক্লাসের সকলের সঙ্গে ওর ভাব হতে, মানিয়ে নিতে মাসখানেক সময় লেগেছিল। তার পর তো আমরা খুব ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম। ওকে আমরা গনি বলে ডাকি। ওর লড়াই, যে ভাবে ও সমস্ত বাধা অতিক্রম করেছে, তা আমাদের কাছেও অনুপ্রেরণা।’’
আইনি লড়াই কী ভাবে জিতলেন গণেশ? তাঁর আইনজীবীর মূল বক্তব্য ছিল, এমবিবিএস পড়ে সকলে যে চিকিৎসক হন, তা তো নয়! কেউ শিক্ষকতা করেন, কেউ গবেষণা করেন, কেউ মেডিক্যাল প্রশাসনের কাজে যুক্ত হন। ফলে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে কাউকে এমবিবিএস ডিগ্রিটুকু পাওয়ার সুযোগ না-দেওয়া অন্যায়। আদালত তাঁদের যুক্তিতে সায় দিয়েছে।
এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে কোন পথে হাঁটবেন গণেশ? চিকিৎসাই করবেন? রোগীরা তাঁকে দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হন। তা স্বাভাবিকও, মেনে নিচ্ছেন ভাবনগর হাসপাতালের ২৫ বছর বয়সি মেডিক্যাল অফিসার। চিকিৎসক কাটারিয়া তাঁকে ইউপিএসসি দিয়ে প্রশাসনে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে তিনি আপাতত স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা এগোতে চান। ‘‘অস্ত্রোপচারের জন্য শারীরিক ভাবে দক্ষ চিকিৎসকের প্রয়োজন। কেন আমি জেনেশুনে কোনও রোগীর জীবন নিয়ে ঝুঁকি নেব?’’ বলতে বলতে চেম্বারের দিকে পা বাড়ালেন গণেশ।