অবসান ঘটাবেন নেহরু যুগের, ইঙ্গিত লালকেল্লার বক্তৃতায়

স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ১৫ অগস্ট লালকেল্লায় কোনও প্রধানমন্ত্রী লাল পাগড়ি পরে বক্তৃতা দেননি। ইদানীং কালে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট না-পরে, বুলেটপ্রুফ কাচের ঘেরাটোপে না দাঁড়িয়ে এমনকী মাথার উপর কালো ছাতা না রেখেও বক্তৃতা দেননি কেউ। সেই রীতি বদলালেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। কিন্তু চোখে পড়া এই বদলের বাইরে দীর্ঘ এক ঘণ্টার বক্তৃতায় আরও একটা বদল নিঃশব্দে করে ফেললেন তিনি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪৫
Share:

স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ১৫ অগস্ট লালকেল্লায় কোনও প্রধানমন্ত্রী লাল পাগড়ি পরে বক্তৃতা দেননি। ইদানীং কালে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট না-পরে, বুলেটপ্রুফ কাচের ঘেরাটোপে না দাঁড়িয়ে এমনকী মাথার উপর কালো ছাতা না রেখেও বক্তৃতা দেননি কেউ।

Advertisement

সেই রীতি বদলালেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। কিন্তু চোখে পড়া এই বদলের বাইরে দীর্ঘ এক ঘণ্টার বক্তৃতায় আরও একটা বদল নিঃশব্দে করে ফেললেন তিনি। ভারতের সুদীর্ঘ নেহরুবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে শুরু করলেন নতুন বিজেপি যুগ।

লোকসভা ভোটের প্রচারপর্বেই ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়ার কথা বলেছিলেন মোদী। সরকার গড়ার পরে সর্দার বল্লভভাই পটেলের ১৮২ মিটার উঁচু মূর্তি স্থাপনের জন্য বাজেটে আড়াই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা থেকে শুরু করে অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতরত্ন দেওয়ার প্রস্তাব হাওয়ায় ভাসিয়ে সেই পথেই হাঁটতে শুরু করেছেন তিনি। শুক্রবার স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতায় উৎপাদনমুখী এক নতুন ভারত নির্মাণের কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী। এবং সমাজতান্ত্রিক নেহরুকে স্মরণ করার প্রয়োজন নেই।

Advertisement

যোজনা কমিশন বিলোপ করার ঘোষণা বিজেপি-যুগ সূচনার লক্ষ্যে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। কারণ, নেহরুর সমাজতান্ত্রিক মডেলের সঙ্গে যোজনা কমিশন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ধাঁচে নিজে এই সংস্থা গড়েছিলেন তিনি। বলতেনও, ‘আমি সমাজতন্ত্রী’। (যদিও অনেকের মতে, নেহরু প্রকাশ্যে নিজেকে সমাজতন্ত্রী দাবি করলেও তিনি উৎপাদনমুখী বৃদ্ধিই চেয়েছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদনে জোর দিয়েছিলেন ইন্দিরা গাঁধীও।) মোদী বলেছেন, “সাবেকি সমাজতন্ত্রের সোভিয়েত মডেলের তো কবেই অপমৃত্যু ঘটেছে। এখন আমাদের প্রয়োজন ভারতের শিল্পক্ষেত্রে জোয়ার আনার জন্য উৎপাদন বৃদ্ধি।”

যে ঘোষণাকে সনিয়া গাঁধীর বিপরীত অবস্থান হিসেবেই দেখা হচ্ছে। ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন এবং জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান হিসেবে উৎপাদনের চেয়ে সরবরাহের উপরেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন সনিয়া। সেই অভিমুখ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিতে চান মোদী। সরকারি প্রকল্প থেকে মুছে ফেলতে চান গাঁধী পরিবারের ছাপ।

তবে এত দিন ধরে চলে আসা সামাজিক প্রকল্পগুলির উপরে তিনি যে স্টিমরোলার চালাতে চান না, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন মোদী। তাই বলেছেন, তিনি চান প্রতিটি সাংসদ একটি করে গ্রামকে দত্তক নিয়ে তার উন্নয়ন করুন। বলেন, মেয়েদের স্কুলে শৌচাগার নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা। অনেকের মতে, সামাজিক সমস্যাগুলিকে চিহ্নিতের মধ্যে একটা জিনিস স্পষ্ট। তা হল, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদীর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রবল হলেও তিনি তাঁর দক্ষিণপন্থী সংস্কারের অভিমুখকে সুকৌশলে বাস্তবায়িত করতে চান।

লিখিত বক্তৃতা নিয়ে লালকেল্লায় যাননি মোদী। কয়েকটা পয়েন্ট লেখা কাগজ দেখে তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু এতটুকু অগোছালো ছিল না সেই ভাষণ। যেখানে যে বার্তা দেওয়ার, দিয়েছেন সুকৌশলে। যেমন বলেছেন, তিনি সকলকে নিয়ে চলতে চান। প্রতিটি রাজনৈতিক দল, এমনকী বিরোধীদেরও নিয়ে। বোঝাতে চেয়েছেন, কংগ্রেস যদি অসহযোগিতার পথে হাঁটে, সেই দায় তাঁর নয়।

বন্ধুত্বের বার্তা দিয়েছেন প্রতিবেশী দেশগুলিকে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্থিক বিকাশ ঘটিয়ে এই অঞ্চলে দারিদ্র দূর করতে চেয়েছেন। এমনকী তীব্র করেননি পাকিস্তান বিরোধিতাও। অতীতে অনেক প্রধানমন্ত্রীই যা করেছেন। দু’দিন আগে কার্গিলে গিয়ে পাকিস্তান সম্পর্কে যা বলার বলেছেন মোদী। ১৫ অগস্ট এড়িয়েছেন নতুন করে সংঘাতের আবহ। বরং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বলেছেন, “যে মারে, তার চেয়ে যে বাঁচায় তার শক্তি বেশি।”

সরকার পরিচালনা থেকে কূটনীতি, সর্বত্রই নয়া পথে হাঁটতে চান মোদী। কিন্তু দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি তাঁর ‘প্রিন্স’ বইয়ে লিখেছিলেন, “রাজার পক্ষে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল নতুন কিছু করা। স্থিতাবস্থা বজায় রাখা সহজ।” নতুন ‘প্রিন্স’ বক্তৃতায় যা-ই বলুন, বাস্তবে থোড় বড়ি খাড়ার বদলে সত্যিই নতুন ভারত গড়তে পারবেন তো প্রশ্ন বিরোধীদের।

• প্রধানমন্ত্রী নই, আমি আপনাদের প্রধান সেবক।

• দিল্লিতে এসে, ক্ষমতার অলিন্দে তাকিয়ে চমকে উঠেছি। সরকারের ভিতরে যেন ডজন সরকার চলছে। মনে হচ্ছে আলাদা আলাদা জমিদারি।

• মেয়ে হলে এতো প্রশ্ন, কিন্তু ছেলেদের কি আমরা প্রশ্ন করি, কোথায় যাচ্ছে, বন্ধু কে? ধর্ষণকারীরা তো কারও না কারও ছেলে।

• কাঁধে বন্দুক নিয়ে মাওবাদীরা মাটিকে লাল করে তুলতে পারে। কখনও কি ওরা ভেবেছে, যদি কাঁধে হাল হতো, তা বলে মাটি কেমন সবুজ হয়ে উঠতে পারত।

• জাতিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে লড়াই বন্ধ থাকুক। পরের দশ বছর এই অশান্তি থেকে দূরে থাকার মন তৈরি করুন।

• সরকারি কর্মীদের প্রতি আমার প্রশ্ন, তাঁরা যে পরিষেবা দেওয়ার কথা বলেন, সেই শব্দটা জোর হারিয়ে ফেলেনি তো?

• সাংসদরা প্রত্যেকে একটা করে গ্রাম দত্তক নিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন